মধ্যপ্রাচ্যের
দেশগুলোতে যেসব হিফয কিংবা ক্বারীয়ানা প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হয়, সেসবে বাংলাদেশের মাদরাসা ছাত্ররাই সবসময় প্রথম-দ্বিতীয় স্থান
লাভ করে থাকে। বিভিন্ন পত্র-পত্রিকা এবং ইন্টারনেটের সংবাদমাধ্যমে এ সম্পর্কিত খবর
নিয়মিত দেখা যায়। এদেশের মাদরাসা শিক্ষার্থীদের মাতৃভাষা হলো বাংলা, তারপরও তারা মধ্যপ্রাচ্যের আরবীভাষী প্রতিযোগীদের হারিয়ে পুরস্কার
লাভ করে।
বিপরীতে ইংরেজি
মাধ্যমে যারা শিক্ষালাভ করে, তারা স্কুল-কলেজে
দশ-বারো বছর ইংরেজি পড়েও কিন্তু ইংরেজিতে স্বচ্ছন্দ হতে পারে না। ইংরেজিতে ঠিকমতো লেখা
কিংবা কথা বলাটাও এদেশের অধিকাংশ স্কুল-কলেজ পড়–য়ার পক্ষেই সম্ভব হয় না।
কিন্তু এই
বৈপরিত্য কেন? এদেশের স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীরা
স্বচ্ছল পরিবারের হওয়ার কারণে যতোটা সুবিধাপ্রাপ্ত হয়ে বড় হয়, যতোটা পুষ্টিকর খাবার পায়, তা মাদরাসার সিংহভাগ শিক্ষার্থীই পায় না।
আসলে ইংরেজিভিত্তিক
ধর্মহীন শিক্ষা আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা নয়, কখনো ছিলও না। আমরা জানি যে, ব্রিটিশরা ১৮৩৫ সালে
ফারসী ভাষা বাদ দিয়ে এদেশে ইংরেজি ভাষা চালু করেছিল। কিন্তু শুরুর দিকে ব্রিটিশরা এদেশে
ইংরেজি ভাষা চালু করতে চায়নি। কারণ ব্রিটিশরা ইংরেজিভাষী হিসেবে এটি বুঝতে পেরেছিল
যে,
এদেশের মানুষ কখনোই ইংরেজিতে অভ্যস্ত হতে পারবে না, কথাবার্তা চালাতে পারবে না। কারণ ইংরেজি এদেশের মানুষের রক্তে
নেই।
এ প্রসঙ্গে
কলকাতার প্রাবন্ধিক নীরদ সি চৌধুরী তার ‘আত্মঘাতী বাঙালী’ গ্রন্থের ৩৬ পৃষ্ঠায় উল্লেখ করেছে- “১৮৩৫ সালে যখন ইংরেজিকেই শিক্ষার বাহন বলিয়া গ্রহণ করা হইল, তখন ভারতপ্রবাসী সমস্ত উচ্চপদস্থ ইংরেজ উহার বিরোধী ছিল। কেবল
ইংরেজি-জানা বাঙালি হিন্দুদের পীড়াপীড়িতে ও পাদ্রী মেকলের সমর্থনে বেন্টিঙ্ক উহার অনুমোদন
করে। যে সব ইংরেজ ইংরেজি শিক্ষার বিদ্বেষী ছিল তাহাদের প্রথম যুক্তি ছিল যে ভারতীয়রা
কখনই ইংরেজি ভাষা ভালো করিয়া আয়ত্ত করিতে পারিবে না।”
নীরদ সি চৌধুরীর
বক্তব্যে উল্লেখিত পাদ্রী মেকলে ১৮৩৫ ঈসায়ীর ২রা ফেব্রুয়ারিতে ব্রিটিশ পার্লামেন্টে
একটি বক্তব্য প্রদান করেছিল ভারতে ফারসী ভাষা রদ করে ইংরেজি শিক্ষা জারি করতে। সে বলেছিল-
“I have travelled across the length and breadth of
India and I have not seen one person who is a beggar, who is a thief. Such
wealth I have seen in the country, such high moral values, people of such
caliber, that I do not think we would conquer this country, unless we break the
very backbone of this nation, which is her spiritual and cultural heritage, and
therefore, I propose that we replace her old and ancient education system, her
culture, for if the Indians think that all that is foreign and english is good
and greater than their own, they will lose their self esteem, their native
culture and they will become what we want them, a truly dominated nation.”
অর্থ: “আমি
ভারতবর্ষের প্রতিটি আনাচে-কানাচে ভ্রমণ করেছি এবং আমি কোনো ভিক্ষুক কিংবা চোরের দেখা
পাইনি। এত প্রাচুর্য আমি এই দেশে দেখেছি, এতো উচ্চ নৈতিকতা, এতো আত্মসম্মানবোধ
আমি ভারতবর্ষের মুসলমানগণ উনাদের মাঝে দেখেছি যে, আমার ভয় হয় আমরা ব্রিটিশরা কখনোই ভারতবর্ষকে কব্জা করতে পারবো না। যদি না আমরা
এই জাতির মেরুদ- ভেঙে দেই, যে মেরুদ- হচ্ছে
মুসলমানগণ উনাদের আধ্যাত্মিকতা তথা ইলমে তাছাউফ ও ইসলামী তাহযীব-তামাদ্দুনের ঐতিহ্যবাহী
ধারা।
সুতরাং আমি
পাদ্রী মেকলে প্রস্তাব করছি যে, ভারতীয় মুসলমানগণ
উনাদের সুপ্রাচীন ও ঐতিহ্যবাহী শিক্ষাব্যবস্থা, উনাদের তাহযীব-তামাদ্দুনকে বিজাতীয় শিক্ষাব্যবস্থা ও সংস্কৃতি দ্বারা প্রতিস্থাপিত
করা হোক। যদি মুসলমানদের মনে এটি ঢুকিয়ে দেয়া যায় যে, বিজাতীয় ও ব্রিটিশ সমস্ত কিছুই মুসলমানদের নিজেদের যা আছে তার
তুলনায় উত্তম, সেক্ষেত্রে মুসলমানরা তাদের আত্মসম্মানবোধ
ও নিজস্ব সংস্কৃতি হারিয়ে ফেলবে এবং মুসলমানরা পরিণত হবে সেরকম জাতিতে যা আমরা ব্রিটিশরা
চাই,
একটি সত্যিকারের পদানত জাতিতে।” (নাউযুবিল্লাহ!)
পাদ্রী মেকলে
ইংরেজদের বুঝিয়েছিল যে, ইংরেজি ভাষা যেহেতু
ভালো করে আয়ত্ত করতে পারবে না এ অঞ্চলের মানুষেরা, সে কারণেই ব্রিটিশদের প্রাধান্য বিস্তারের জন্য ভারতীয় মুসলমানদের উপর ইংরেজি ভাষা
চাপিয়ে দিতে হবে। কারণ ভারতীয় মুসলমানরা হাজার বছর ধরে আরবী-ফারসী, পবিত্র কুরআন শরীফ-পবিত্র সুন্নাহ শরীফ ভিত্তিক যে শিক্ষাব্যবস্থা
লালন করে আসছে, তা ভারতীয় মুসলমানদের মেরুদ-স্বরূপ।
একটি ট্রেন তার লাইনেই কেবল চলতে পারে, সে মাটির রাস্তায় চলতে পারে না। ঠিক সেভাবেই ফারসী ভাষা রদ করে ইংরেজি চাপিয়ে দিলে
মুসলমানদের বিকাশ বাধাগ্রস্ত হবে, ফলে ব্রিটিশদের পক্ষে
ভারতবর্ষ দখলে নেয়া সহজ হবে।
আর হিন্দুরাও
ব্রিটিশদের প্ররোচিত করেছিল ফারসী ভাষা তুলে দিতে। কারণ ফারসী ভাষার কারণে ব্রিটিশআমলের
শুরুর দিকেও প্রশাসনে মুসলমানদের প্রাধান্য বজায় ছিলো। ফারসী ভাষা তুলে দেয়ার পরই হিন্দুরা
প্রাধান্য বিস্তার করার সুযোগ পায়।
বর্তমান মুসলমানদের
মধ্যে একটি ভুল ধারণা রয়েছে যে, আরবী ভাষাকে শিক্ষার
মাধ্যম হিসেবে গ্রহণ করলে তারা পিছিয়ে পড়বে। কিন্তু ইতিহাস তো বলছে, যখন ভারতবর্ষে আরবী-ফারসী ভাষা শিক্ষার মাধ্যম ছিল, তখন মুসলমানরা ছিল রাজা-বাদশাহ, আমীর-ওমরাহ। আজ আরবী-ফারসী বাদ দিয়ে ইংরেজি শিখে কী মুসলমানরা
রাজা হতে পেরেছে, না তারা ইংরেজিভাষী
বিধর্মীদের গোলাম হয়েছে? নাউযুবিল্লাহ!
যদি মাদরাসার
সুবিধাবঞ্চিত শিক্ষার্থীরা মধ্যপ্রাচ্যে গিয়ে পুরস্কার জিতে আসতে পারে, সেক্ষেত্রে আমাদের স্বচ্ছল সমাজ যদি তাদের সন্তানদের আরবী-ফারসী
ভাষায় শিক্ষা দেয়ার ব্যবস্থা করতো, তার ফলাফল কী হতো? এখন চৌদ্দ-পনের বছর
ধরে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে ইংরেজি পড়ার পরও এদেশের স্বচ্ছল পরিবারের শিক্ষার্থীরা আনাড়ি-নবিশ
হচ্ছে। যদি আরবী-ফারসী ভাষায় তাদের শিক্ষার ব্যবস্থা করা হতো, তাহলে তারাই হতো সবচেয়ে শিক্ষিত ও অগ্রগামী।
হিন্দুরা
তখন ফারসী ভাষাকে তুলে দেয়ার পক্ষ নিয়েছিল মুসলমানদের প্রাধান্য নষ্ট করার জন্য। কিন্তু
ব্রিটিশ আমল তো সেই পঞ্চাশ বছরেরও বেশি সময় আগে শেষ হয়ে গিয়েছে, ভারতবর্ষে মুসলমানদের দুটি স্বাধীন দেশ বাংলাদেশ ও পাকিস্তান
রয়েছে। তারপরও উপমহাদেশে, এমনকি ৯৮ শতাংশ মুসলমানদের
বাংলাদেশেও হিন্দুদের প্রাধান্য টিকে রয়েছে কেন?
কারণ হিন্দুরা
ব্রিটিশদের প্ররোচনা দিয়ে যে আরবী-ফারসী বর্জিত মুসলিমবিরোধী শিক্ষাব্যবস্থা জারি করেছিল
মুসলমানদের প্রাধান্য রদ করার জন্য, সেটিই এখন পর্যন্ত মুসলমানরা ধরে রেখেছে। মুসলমানরা তাদের হারানো শিক্ষাব্যবস্থাকে
ফিরিয়ে আনেনি। যদি মুসলমানরা তাদের পবিত্র কুরআন শরীফ-পবিত্র সুন্নাহ শরীফ ভিত্তিক
শিক্ষাব্যবস্থাকে ফিরিয়ে আনতো, তাহলে আজকে ফের ভারতবর্ষে
মুসলমানদের হারানো রাজত্ব প্রতিষ্ঠিত হতো এবং হিন্দুরা ফের মুসলমানদেরই গোলামি করতো।
প্রবাদে রয়েছে, বন্যেরা বনে সুন্দর, শিশুরা মাতৃক্রোড়ে। সঠিক বিকাশের জন্য চাই উপযুক্ত পরিবেশ, উপযুক্ত শিক্ষাব্যবস্থা। আমাদের ভারতবর্ষের মুসলমানদের রক্তে
হাজার বছর ধরে আরবী-ফারসী প্রবাহমান, পবিত্র কুরআন শরীফ-পবিত্র সুন্নাহ শরীফ প্রবাহমান। মাদরাসার শিক্ষার্থীরা সুবিধাবঞ্চিত
হওয়ার পরও যে কৃতিত্ব দেখাতে পারে, তা স্রেফ তাদের রক্তে আরবী-ফারসী থাকার কারণে। যদি এর সাথে যোগ হয় পৃষ্ঠপোষকতা, সঠিক পরিবেশ, পুষ্টিকর খাদ্য ও আর্থিক সুবিধা, সেক্ষেত্রে বাংলাদেশই হতো বিশ্বের সবচেয়ে উন্নত দেশ। সেক্ষেত্রে বাঙালি মুসলমানদের
অগ্রযাত্রাকে আর কেউ রুখে দিতে পারতো না।
No comments:
Post a Comment