পবিত্র কুরআন শরীফ উনার মধ্যে বর্ণিত চারটি হারাম বা সম্মানিত মাস উনাদের মধ্যে একটি মাস হলো- ‘পবিত্র রজবুল হারাম শরীফ’। যে আশ্চর্যজনক ঘটনা পবিত্র রজবুল হারাম মাস উনার তাৎপর্য ও গুরুত্বকে বহুগুণ বৃদ্ধি করেছে, তা হচ্ছে পবিত্র মি’রাজ শরীফ। পবিত্র মি’রাজ শরীফ উনার শব্দগত অর্থ- ‘ঊর্ধ্বারোহণ’।
চন্দ্র মাস অর্থাৎ আরবী তারিখ অনুযায়ী রাত্রি আগে গণনা করা হয়। বিধায় এ বছরের জন্য অর্থাৎ ১৪৩৮ হিজরী সনের জন্য ২৬শে রজবুল হারাম শরীফ মুাতাবিক ২৫ হাদি ’আশার ১৩৮৪ শামসী (২৪ এপ্রিল ২০১৭ ঈসায়ী), ইয়াওমুল ইছনাইনিল আযীম (সোমবার) দিবাগত রাত্রিটি “পবিত্র মি’রাজ শরীফ” উনার মহিমান্বিত রাত।
পবিত্র মি’রাজ শরীফ হলো- নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার বেমেছাল ফাযায়িল-ফযীলত উনার মধ্যে হতে একটি বিশেষ ফাযায়িল-ফযীলত; যা বিশ্বাস করা প্রত্যেক মুসলমানের জন্য ফরয। আর অস্বীকার ও অবজ্ঞা করা কাট্টা কুফরীর অন্তর্ভুক্ত।
নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি পবিত্র মি’রাজ শরীফ উনার রজনী মুবারকে আনুষ্ঠানিকভাবে মহান আল্লাহ পাক উনার দীদার মুবারকে গমন করেন। অর্থাৎ প্রথম আসমান থেকে শুরু করে সপ্তম আসমান অতিক্রম করে সিদরাতুল মুনতাহা অতিক্রম করলেন- যেখানে হযরত জিবরীল আলাইহিস সালাম তিনি বলেছেন, আমি যদি সিদরাতুল মুনতাহা থেকে এক চুল পরিমাণ অগ্রগামী হই; তাহলে আমার ছয়শত (অন্য বর্ণনায় ছয় হাজার) পাখা জ্বলে-পুড়ে ছারখার হয়ে যাবে। তাই তিনি সেখানে রয়ে গেলেন; সামনে আর অগ্রসর হলেন না। নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি সেই সিদরাতুল মুনতাহা অতিক্রম করে মহান আল্লাহ পাক উনার পরম দীদার মুবারকে গেলেন। এরপর আরো অনেক ঘটনা সংঘটিত হয়েছিল। নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি জান্নাত দেখলেন, জাহান্নাম দেখলেন। পবিত্র কুরআন শরীফ উনার মধ্যে এসেছে, নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি মহান আল্লাহ পাক উনার দীদার মুবারকে এতোটাই নিকটবর্তী হয়েছিলেন যেমন- ধনুকের দুই মাথা যত নিকটবর্তী হয় বরং তার চেয়েও অধিক নিকটবর্তী হয়েছিলেন। সুবহানাল্লাহ!
বলাবাহুল্য, এমন অতীব গুরুত্বপূর্ণ, ফযীলতপূর্ণ রাতটি সম্পর্কে রাষ্ট্রদ্বীন সম্মানিত ইসলাম উনার দেশ- বাংলাদেশ সরকারের ধর্ম মন্ত্রণালয় বা ইসলামিক ফাউন্ডেশন কোনোই আলোকপাত করেনি।
৯৮ ভাগ মুসলমান অধ্যুষিত এবং রাষ্ট্রদ্বীন পবিত্র ইসলাম উনার এদেশে এটা স্বীকৃত হতে পারে না। সর্বোপরি ‘পবিত্র কুরআন শরীফ ও পবিত্র সুন্নাহ শরীফ উনাদের বিরোধী কোনো আইন পাস হবে না’- এ নির্বাচনী প্রতিশ্রুতিবদ্ধ সরকারের জন্যও বরদাশতযোগ্য হতে পারে না।
সেই সাথে এদেশের শতকরা ৯৮ ভাগ অধিবাসী মুসলমান উনারাও এ ব্যাপারে নীরব ভূমিকা পালন করতে পারেন না, নিষ্ক্রিয় থাকতে পারেন না। পবিত্র দ্বীন ইসলাম উনার প্রতিটি পর্ব; বিশেষতঃ সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার সংশ্লিষ্ট প্রতিটি অনুষঙ্গ এদেশের মুসলিম জনগণ ও সরকারকে যৌথভাবে যথাযথ গুরুত্ব, আদব, মুহব্বত, জজবা ও শান-শওকতের সহিত পালনের জন্য সর্বোত সক্রিয় হতে হবে। সরকারি ছুটি নিশ্চিত করতে হবে এবং আন্তর্জাতিকভাবে পালনের জন্য সক্রিয় উদ্যোগ গ্রহণ ও বিশেষ পৃষ্ঠপোষকতা নিশ্চিত করতে হবে।
সে যুগে কাফিররা পবিত্র মি’রাজ শরীফ উনাকে নিয়ে দ্বিধাদ্বন্দ্বে ছিল; এ যুগেও কাফিরদের অনুসারীরা তদ্রƒপ দ্বিধাদ্বন্দ্বে ভুগে।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, মহান আল্লাহ পাক তিনি আকাশকে সাত স্তরে তৈরি করেছেন। পৃথিবীর নিকটতম আকাশকে করেছেন তারকারাজি তথা গ্রহ-নক্ষত্র দ্বারা সুশোভিত। যাদের সংখ্যা, প্রকৃতি ও অস্তিত্ব সম্পর্কে কাফিরদের জ্ঞান আজো খুবই নগণ্য। তাদের গবেষণা এখনো প্রথম আসমানের নিচে। নিকট সৌরজগতের গ-িই তারা এখনো ভালোভাবে অতিক্রম করতে পারেনি।
কাজেই পবিত্র মি’রাজ শরীফ সম্পূর্ণই মহান আল্লাহ পাক উনার কুদরত ও নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার মু’জিযা শরীফ উনার অন্তর্ভুক্ত। বলা আবশ্যক, পবিত্র মি’রাজ শরীফ উনার মাধ্যমে যে অনন্য নিয়ামত মুবারক মহান আল্লাহ পাক তিনি উনার দীদার মুবারক উনার হাবীব নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনাকে আনুষ্ঠানিকভাবে হাদিয়া করেছেন; তাতে নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি উম্মতকেও অংশীদার করেছেন পবিত্র ছলাত আদায় করার মাধ্যমে। অর্থাৎ ‘ছলাত’ই হলো উনার মূল সওগাত।
প্রসঙ্গত, পবিত্র মি’রাজ শরীফ উনার ঘটনায় আরেকটি বিষয় প্রতিভাত হয় যে, মুসলমানের জীবন চেতনা ঊর্ধ্বমুখী। মুসলমান বিশ্বাস করে- যা কিছু ফায়ছালা হয় সাত আসমানের উপরে। মুসলমান প্রতিদিন কমপক্ষে ১১বার আসমান অভিমুখে দু’হাত উত্তোলন করে। এ উত্তোলন অত্যন্ত প্রাণবন্ত ও নিখুঁত প্রতীকী। এর দ্বারা প্রকাশ পায় যে- মুসলমান দুনিয়ার কারো ইবাদত করে না এবং দুনিয়ায় কারো কাছে কিছু চায় না; যা মুসলমানগণ নামাযে বলে থাকে। কাজেই মুসলমান যদি সত্যিকার নামাযী হতো, তাহলে তাদের কোনোই সমস্যা থাকতো না।
হিসাব মতে, সারা পৃথিবীতে প্রায় সাড়ে তিনশত কোটি মুসলমান; যাদের প্রতি প্রত্যেহ পাঁচ ওয়াক্ত নামায পড়া ফরয। পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার মধ্যে ইরশাদ মুবারক হয়েছে, “যে ব্যক্তি পাঁচ ওয়াক্ত নামায পড়ে তার দ্বারা স্বাভাবিকভাবে কোনো পাপ কাজ হওয়া সম্ভব নয়।”
তাহলে প্রতিভাত হচ্ছে, যেসব মুসলমান নামায পড়ছে, কিন্তু পাপ ছাড়তে পারছে না- আসলে তাদের নামাযই হচ্ছে না। এর পেছনে কারণ হলো- তাদের কলুষযুক্ত ক্বলব বা অন্তঃকরণ। তারা নামাযে দাঁড়িয়ে মুখে আওড়াচ্ছে পবিত্র সূরা ফাতিহা শরীফ। কিন্তু মাথায়, মনে গিজগিজ করছে বিভিন্ন চিন্তা। এ ধরনের নামাযী সম্পর্কেই ইরশাদ মুবারক হয়েছে, “ওই মুছুল্লীর জন্য জাহান্নাম, যে নামাযে বেখেয়াল থাকে।” নাউযুবিল্লাহ! (পবিত্র সূরা মাঊন শরীফ : পবিত্র আয়াত শরীফ ৪, ৫)
সাবেত হয় যে, নামাযে দাঁড়িয়ে তারা মুখে যতই পবিত্র কুরআন শরীফ উনাকে তিলাওয়াত করুক, তা তাদের ক্বলব বা অন্তঃকরণ পর্যন্ত পৌঁছায় না। এজন্য পবিত্র দ্বীন ইসলাম উনার মধ্যে ক্বলবী যিকির বলে আলাদা যিকিরকে ফরয বলে স্বীকার করা হয়েছে।
পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার মধ্যে ইরশাদ মুবারক হয়েছে, “মানুষের শরীরে এক টুকরা গোশত পি- রয়েছে; তা যখন শুদ্ধ হয়ে যায়, তখন গোটা মানুষটাই শুদ্ধ হয়ে যায়। আর তা যখন অশুদ্ধ হয়ে যায়, তখন গোটা মানুষটাই অশুদ্ধ হয়ে যায়।”
অন্য পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার মধ্যে ইরশাদ মুবারক হয়েছে, “মানুষের ক্বলব যখন যিকির করে, তখন ক্বলবে হযরত ফেরেশ্তা আলাইহিস সালাম আসন নেন এবং নেক কাজে আনন্দ দেন। আর ক্বলব যখন যিকির থেকে গাফিল থাকে, তখন সে শূন্য স্থানে শয়তান বসে যায় এবং পাপ কাজে ওয়াসওয়াসা ও আনন্দ দেয়।”
উল্লেখ্য, এই ক্বলবী যিকির থেকে গাফিল থাকার কারণেই নামধারী, ধর্মব্যবসায়ী উলামায়ে ‘সূ’দের প্রকট প্রাদুর্ভাব চলছে। এদের সম্পর্কে তাই পবিত্র কুরআন শরীফ উনার মধ্যে ইরশাদ মুবারক হয়েছে, “ওই ব্যক্তিকে অনুসরণ করো না, যার ক্বলব আমার যিকির থেকে গাফিল। অর্থাৎ যার ক্বলবে আমার যিকির নেই সে নফসকে (শয়তানকে) অনুসরণ করে। আর তার কাজগুলো সম্মানিত শরীয়ত উনার খিলাফ।” (পবিত্র সূরা কাহাফ শরীফ : পবিত্র আয়াত শরীফ ২৮)
অতএব, ক্বলবী যিকিরবিহীন এসব ধর্মব্যবসায়ীদের দ্বারা কোনোদিনই ক্বলবের শুদ্ধতা হাছিল ও দ্বীনী স্বাদ আস্বাদন এবং নামাযে পবিত্র মি’রাজ শরীফ হাছিল হওয়া সম্ভব নয়।
No comments:
Post a Comment