ভোলাহাট উপজেলার ঐতিহ্যবাহী বিলভাতিয়া বিল থেকে হারিয়ে যাচ্ছে নীরজ উদ্ভিদের মধ্যে শাপলা-শালুক। বিলের মধ্যে বিভিন্ন ডোবায় পানির উপরে ফুটে থাকা শাপলা ফুলের দৃষ্টিকাড়া সৌন্দর্য সত্যিই সকলকে মুগ্ধ করে। আর সেই সাথে সাথে প্রাকৃতিক পরিবেশের সৌন্দর্যও বাড়ায়। তার পরেও এটি বাংলাদেশের জাতীয় ফুল হিসেবে সকলের কাছে পরিচিত। প্রতিকূল পরিবেশে শাপলা ফুলের সেই সমারোহ আর নেই। দিনে দিনে শাপলা-শালুক যেন একেবারেই বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে। অথচ এখন হতে ১৫/২০ বছর আগেও বিলভাতিয়া বিলের বুকজুড়ে শাপলা ফুলের দৃষ্টি নন্দন সৌন্দর্য ছিল চোখে পড়ার মত। সে সময় শরৎকালে বিলভাতিয়া বিলের প্রকৃতি অন্য রকম সাজে সজ্জিত হয়ে উঠতো।
শাপলা ফুল শুধু পরিবেশ ও প্রকৃতির সৌন্দর্যই বৃদ্ধি করতো তা নয়, এর রয়েছে অনেক পুষ্টিগুণ। এছাড়া শাপলার ফুলের গাছ গোড়া ও মাথা সবকিছুই নরম ডাটা বা লাইল মাথায় ও গোড়ায় জন্ম নেয়া ভ্যাঁট ও শালুক সবগুলোই মুখরোচক পুষ্টিকর সমৃদ্ধ খাদ্য উপাদান। শাপলা গাছ বা ডাটা পানির গভীরতায় ৫ থেকে ২০ ফিট পর্যন্ত হয়। নরম কচি আর খস্খসে এ ডাটা বা লাইল খালি মুখে কিংবা ঝাল-লবণ ও তেঁতুল মাখিয়ে মখরোচক সবজি হিসেবে খাবার মজাই আলাদা। মাছ, গোশত রান্নার উৎকৃষ্ট তরকারী হিসেবেও এ ডাটা বা লাইল বেশ জনপ্রিয়।
শাপলা আড়াই তিন মাস বয়সকালে ফুলের পাপড়ি ঝড়ে যায় এবং মাথায় ডালিম ফুলের মতো এক প্রকার গুটি তৈরি হয় যা ঢ্যাপ বা ভ্যাঁট নামে পরিচিত। এ ঢ্যাপ বা ভ্যাঁটের মধ্যে অসংখ্য ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দানা বীজ থাকে। ঢ্যাপ বা ভ্যাঁটের মধ্যে থাকা দানাগুলিকে রোদে শুকিয়ে খুদে বা কোদার চাউল তৈরি করা হতো। ঢ্যাপ বা ভা্যঁটের পুষ্টিকর এ চাউল থেকে তৈরি হয় মুখরোচক খই ও লাড়–। এ ঢ্যাপ বা ভ্যাঁট চাউলের ভাত ও বিরানীসহ নানা স্বাদের খাবার বিভিন্ন অনুষ্ঠানে পরিবেশন করা হয়। কাঁচা ঢ্যাপ বা ভ্যাঁটের দানা কেউ কেউ খালি মুখেই খেতে পছন্দ করতো। ফের কেউ কেউ হাট-বাজার থেকে খরিদ করে আনতো ছোট্ট ছেলে-মেয়েদের জন্য তাদের হাদিয়াস্বরূপ। বর্তমানে এ ঢ্যাপ বা ভ্যাঁট কদাচিৎ
গ্রাম-গঞ্জের হাট-বাজারগুলোতে মিলে। যার নাম কেউ বলে ঢ্যাপ ফের কেউ কেউ ভ্যাঁট বলে থাকে। শাপলা ফুলের গাছের গোড়ার দিকে একাধিক ভ্যাঁটের গুটির জন্ম। গুটিগুলো ধীরে ধীরে বড় হতে থাকে, এগুলোকেই শালুক নামে পরিচিত। একেক শালুকের ওজন সাধারনত ৪০ গ্রাম থেকে ৭০ গ্রাম হয়ে থাকে। শালুক অত্যন্ত সুস্বাদু ও লোভনীয় খাদ্য উপাদান। একবার খেলে বার বার খেতে ইচ্ছে করে। শালুক খুব সহজেই পাচন বা হজমশক্তি বৃদ্ধি করে। দ্রুত ক্ষুধা নির্ধারণ করে শরীরে শক্তি যোগায়। শালুক আগুনে পুড়িয়ে কিংবা সিদ্ধ করে খাওয়া হয়। শালুক পোড়া এখনো প্রবীণদের সেই শৈশব কালের কথা মনে করিয়ে দেয়। আগের দিনে শরতের শেষে বন্যার পানি নেমে গেলে সাথে সাথে বিলভাতিয়া বিলের বিভিন্ন ডোবা, খাল-বিলে ভরে যেত শাপলা-শালুক, সিঙ্গারা-ভা্যঁট আর পদ্মচাকা ও মাখনা তোলার ধুম। শাপলা-শালুকের সাথে সাথে সিঙ্গারা আর পদ্মচাকা ও মাখনাও একেবারেই হারিয়ে যেতে বসেছে বিলভাতিয়া বিল থেকে। এদের মধ্যে মাখনা নামের বস্তুটি একেবারেই হারিয়ে গেছে। হাট-বাজারগুলোতে আর চোখে পড়ে না। মাখনা নামের পানীয় ফলটি শুধুই এখন স্মৃতি। মাখনা নামের ফলটির গায়ে ছিল কাঁটাযুক্ত। কাঁটাকে ছাড়িয়ে তার ভিতরে পাওয়া যেত সুস্বাদু এক দুর্লভ খাদ্যের ফল “মাখনা”। মাখনা সুস্বাদু আর প্রোটিনযুক্ত ফল, যা খেয়ে গ্রাম-গঞ্জের লোকেরা নানা অসুখ-বিসুখ থেকে রক্ষা পেতো বলে জানালেন স্থানীয় গ্রাম্য ডাক্তার কালু মোহাম্মাদ। মাখনার মতো আরো ছিলো পানীয় ফল পদ্মচাকা ও সিঙ্গারা। চাকা ও সিঙ্গারা পানীয় ফলেরও ছিল যেমন সুস্বাদু, তেমনি ছোট্ট ছেলে-মেয়েদের জন্য লোভনীয় খাবার। বর্তমান সময়ে মাঝে মধ্যে এ পানীয় ফলগুলো আগের মতো আর চোখে না, পড়লেও শাপলা-শালুক আর মৌসুম অনুযায়ী সিঙ্গারা-পদ্মচাকা মাঝে মাঝে গ্রাম-গঞ্জের হাট-বাজারগুলোতে চোখে পড়ে এবং সখ করে খায়। কারণ আগের যুগের মতো সেই স্বাদ আর এ পানীয় ফল পাওয়া দুষ্কর। আমরা ছোট বেলায় বাবার সাথে হাট-বাজারে গিয়ে প্রথমেই খুঁজে বের করতাম শাপলা-শালুক, সিঙ্গারা, ভ্যাঁট আর পদ্মচাকা ও মাখনা। এখন শুধুই এ পানীয় ফলগুলো স্মৃতি আর কল্প কাহিনীর মতো। শালুক পোড়া গন্ধ এখনো প্রবীণদের মাঝে শৈশবের কথা মনে করিয়ে দেয়। এ নীরজ উদ্ভিদ এখন বিলুপ্তির পথে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, আবহাওয়ার ব্যাপক পরিবর্তনে আগের মতো সঠিক সময়ে বন্যা হচ্ছে না। বন্যার পানি যতটুকু হওয়ার দরকার তা হচ্ছে না। এছাড়া আবাদি জমিতে অপরিমাণ কীটনাশক ও রাসায়নিক সার প্রয়োগে অনেক বীজ বা মাটির নিচে লুকিয়ে থাকা মা শালুক বিনষ্ট হয়ে যাচ্ছে। ফলে নতুন করে শাপলার গাছ জন্ম হচ্ছে না। ভোলাহাট উপজেলার বিলভাতিয়া বিলের মতো বাংলাদেশের কোথায়ও সেই আগের মতো শাপলা-শালুক, সিঙ্গারা, ভ্যাঁট আর পদ্মচাকা ও মাখনার দেখা মিলে না। বিশেষজ্ঞরা আরো বলছেন, সেই আদি যুগের এ সমস্ত পানীয় ফুল ও ফলের সরকারিভাবে সুচিন্তিত দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার মাধ্যমে উপজেলা পর্যায়ে কৃষি সেক্টরের উদ্যোগে একটু একটু করে ব্যবস্থা করতে পারে। কথায় বলা হয়, বিন্দু বিন্দু নিয়েই গঠিত হয় সিন্ধু। আমাদের দেশে তৃণমূল পর্যায়ের ক্ষেত্রবিশেষে এর সুুুব্যবস্থা করা মনে হয় কোনো প্রকার কঠিন কাজ নয়।
No comments:
Post a Comment