Friday, August 8, 2014

আহ! যদিও পানি একটুখানি; তবুও বেহিসাব নেকীর হাতছানি



আধুনিককালের যান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থায় নিজেদের পরকালীন আমলনামাকে সমৃদ্ধ করতে খুব বেশি কিছু করার সুযোগ আমাদের সবার হয়ে উঠে না। আত্মকেন্দ্রিক ও ভোগবাদী মানসিকতার কারণে এমনটা হচ্ছে। সবসময় বড় অঙ্কের দান-খয়রাত করাও আমাদের সবার জন্য সম্ভব হয় না। অথচ সার্বজনীন, সুন্দর ও মানবতার দ্বীন- পবিত্র ‘ইসলাম’ সবার জন্য খুব সহজেই নেক্কার হওয়ার সুযোগ করে দিয়েছে। জীবনযাপনে মানুষের যা যা প্রয়োজন, পবিত্র দ্বীন ইসলাম সেসব কিছুর মধ্যেই আমাদের জন্য নেকী হাছিলের ব্যবস্থা করেছে। পরকালীন নেকী-পুণ্যের হিসাবের পাশাপাশি এসবের মধ্যে ইহজগতে নিজেদের জনসেবা, জনকল্যাণ ও মানবিকতা চর্চারও নানান উপায় লুকানো রয়েছে।

কাউকে পানি পান করানোর বিষয়টি আজ আমাদের কাছে হয়তো আহামরি কোনো দান কিংবা বিষয় নয়, অথচ পবিত্র দ্বীন ইসলাম উনার দৃষ্টিতে এ সামান্য কাজটিও অসীম নেকী হাছিলের অবলম্বন। ‘বুখারী শরীফ’ উনার মধ্যে একটি পূর্ণ অধ্যায়ের নামকরণ করা হয়েছে- ‘পানি পান করানোর ফযীলত’ শিরোনামে। এ অধ্যায়ে এ বিষয়ে আখিরী রসূল, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার পবিত্র হাদীছ শরীফ উনাদেরকে সন্নিবেশিত করা হয়েছে।
আখিরী রসূল, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি ইরশাদ মুবারক করেন, “সবচেয়ে উত্তম ছদকা হলো মানুষকে পানি পান করানো।” (আহমদ, আবু দাউদ শরীফ)
কিতাবে বর্ণিত আছে- “হযরত সা’দ বিন উবাদা রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু তিনি এসে আখিরী রসূল, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনাকে বললেন, ইয়া রসূলাল্লাহ ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম! আমার মা বিছাল শরীফ গ্রহণ করেছেন। তিনি উনার জন্য কোনো কিছুর ওসিয়ত করে যাননি। আমি যদি উনার পক্ষ হয়ে কিছু ছদকা করি, তবে কি তা আমার মায়ের কোনো উপকারে আসবে? আখিরী রসূল, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি বললেন, হ্যাঁ, হবে। তুমি মানুষকে পানি পান করাও।”
আরো বর্ণিত আছে- “হযরত ইবনে আব্বাস রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু উনাকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, কোন্ দানটি সর্বোত্তম? তিনি বললেন, অন্যকে পানি পান করানো।” আর হযরত ইমাম কুরতুবী রহমতুল্লাহি আলাইহি তিনি একটি পবিত্র আয়াত শরীফ উনার তাফসীর প্রসঙ্গে বলেছেন, “যার গুনাহ বেশি হয়ে গেছে, সে যেন মানুষকে পানি পান করায়।”
ছহীহ ‘বুখারী শরীফ’ উনার মধ্যে বর্ণিত পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার মাধ্যমে আমরা জানতে পারি- পিপাসার্ত কুকুরকে পানি পান করানোর বদৌলতে এক পাপাচারী মহিলাকেও মহান আল্লাহ পাক তিনি মাফ করে দিয়েছেন। সুবহানাল্লাহ!
সামান্য কুকুরের তৃষ্ণা মেটানোয় যদি এতো বড় পুরস্কার হয়, তবে সৃষ্টির সেরা জীব মানুষকে পানি পান করানোর বিনিময় আরো কত মহান হতে পারে- তা কি কখনো ভেবে দেখেছি!
আখিরী রসূল, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি ইরশাদ মুবারক করেন, “যে ব্যক্তি কোথাও একটি কূপ খনন করে দেয় (অর্থাৎ পানির উৎসের ব্যবস্থা করে দেয়) এবং তারপর সেখান থেকে কোনো মানুষ, পশু-পাখি অথবা কোনো প্রাণীও যদি পানি পান করে, তবে প্রত্যেকটির বিনিময়ে মহান আল্লাহ পাক তিনি তাকে ক্বিয়ামতের দিন নেকী দান করবেন।” সুবহানাল্লাহ! এখানে মূলত গ্রাম-গঞ্জ-শহর বা অঞ্চল ভেদে যে কোনোভাবে পানি পান করার ব্যবস্থা করে দেয়ার ফযীলত বোঝানো হয়েছে।
‘আত্ তারগীব ওয়াত্ তারহীব’ গ্রন্থে উল্লেখ করা হয়েছে- “হাদীছ শাস্ত্রের প্রসিদ্ধ ইমাম হযরত ইমাম হাকিম রহমতুল্লাহি আলাইহি তিনি একবার অসুস্থ হয়ে পড়লেন। উনার চেহারায় ফোড়া দেখা দিলো এবং আকৃতি যেন বদলে গেল। তখন তিনি উনার বাড়ির দরজায় সাধারণ পথচারীদের জন্য পানি পানের ব্যবস্থা করে দিলেন। লোকেরা চলতিপথে পিপাসার্ত হলে সেখান থেকে পানি পান করে নিতো। মাত্র এক সপ্তাহের মধ্যেই তিনি সুস্থ হয়ে গেলেন। উনার চেহারায় আগের চেয়েও সৌন্দর্য বেড়ে গেল।” উল্লেখ্য যে- হযরত ইমাম হাকিম রহমতুল্লাহি আলাইহি তিনি মূলত ওই পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার উপর আমল করেছিলেন, যেখানে আখিরী রসূল, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি ইরশাদ মুবারক করেছেন, “তোমরা তোমাদের অসুস্থ ব্যক্তিদের জন্য ছদকা করো, এতে তাদের সুস্থতা নিহিত।”
প্রসিদ্ধ ইমাম ও বুযুর্গ হযরত আব্দুল্লাহ বিন মুবারক রহমতুল্লাহি আলাইহি উনার কাছে এক লোক এসে তার হাঁটুতে ক্ষত সম্পর্কে জানালো। লোকটি বললো, আমি অনেক ধরনের চিকিৎসা করিয়েও কোনো সুফল পাচ্ছি না। আমিরুল মু’মিনীন ফিল হাদিছ হযরত আব্দুল্লাহ বিন মুবারক রহমতুল্লাহি আলাইহি তিনি তখন তাকে বললেন- যাও, অমুক জায়গায় গিয়ে সেখানে একটি কূপ খনন করে দাও। ওখানকার মানুষ পানির জন্য কষ্ট পায়। আমি আশা করি, এতে তুমি সুস্থ হয়ে উঠবে। লোকটি উনার কথামতো সেখানে একটি কূপ খনন করে দিলো এবং সত্যিই কয়েকদিন পর সে সুস্থ হয়ে উঠলো। সুবহানাল্লাহ!

শহরে নগরে রাজপথে হেঁটে চলা ক্লান্ত পথিকের সংখ্যা মোটেও কম নয়। আপনার আমার বাসা-বাড়ি কিংবা দোকানের সামনে দিয়ে প্রতিনিয়ত অসংখ্য পথচারী পথ চলছে। পথচারী মানুষের সেবার উদ্দেশ্যে কোথাও যদি ড্রামভর্তি বিশুদ্ধপানি আর দু’য়েকটি গ্লাস আমরা রেখে দিই, তবে নিজেদের মানবিকতার বিশুদ্ধ চর্চার পাশাপাশি তা আমাদের আখিরাতেও অসীম নেকী হাছিলের দুয়ার খুলে দেবে।
নিজেদের সামর্থ্য অনুযায়ী আমরা যদি স্ব স্ব অবস্থানে থেকে পিপাসার্ত মানুষের পিপাসা মেটাতে কিছু করার উদ্যোগ নিই, তবে কাল-ক্বিয়ামতের মাঠে এটুকুই হয়তো আমাদের জন্য অনেক বড় সঞ্চয় হয়ে থাকবে। সামান্য এক গ্লাস পানির বিনিময়ে মহান আল্লাহ পাক তিনি যদি আমাদের উপর সন্তুষ্ট হয়ে যান, তবে এমন সৌভাগ্যবান আর কে আছে!

No comments:

Post a Comment