ছোট
সোনামসজিদ ‘সুলতানি স্থাপত্যের রত্ন’ বলে সুপরিচিত। এটি বাংলার রাজধানী
গৌড়-লখনৌতির ফিরোজপুর কোয়াটার্স এর তোহাখানা কমপ্লেক্স থেকে অর্ধ কিলোমিটার
দক্ষিণ-পূর্বে এবং কোতোয়ালী দরজা থেকে প্রায় তিন কিলোমিটার দক্ষিণে
অবস্থিত। বিশাল এক দিঘির দক্ষিণপাড়ের পশ্চিম অংশ জুড়ে এর অবস্থান। মসজিদের
কিছু দূর পশ্চিমে বাংলাদেশ সরকারের প্রত্নতত্ত্ব অধিপ্তর কর্তৃক কয়েক বছর
পূর্বে নির্মিত একটি আধুনিক দ্বিতল গেষ্ট হাউস রয়েছে। গেষ্ট হাউস ও মসজিদের
মধ্য দিয়ে উত্তর-দক্ষিণে একটি আধুনিক রাস্তা চলে গেছে। মনে হয় রাস্তাটি
পুরনো আমলের এবং একসময় এটি কোতোয়ালী দরজা হয়ে দক্ষিণের শহরতলীর সঙ্গে
গৌড়-লখনৌতির মূল শহরের সংযোগ স্থাপন করেছিল।
ছোট সোনামসজিদ
প্রধান
প্রবেশ পথের উপরিভাগে স্থাপিত একটি শিলালিপি অনুযায়ী জনৈক মজলিস-ই-মাজালিস
মজলিস মনসুর ওয়ালী মুহম্মদ বিন আলী কর্তৃক মসজিদটি নির্মিত হয়। শিলালিপিতে
নির্মানের সঠিক তারিখ সম্বলিত অক্ষরগুলি মুছে গেছে। তবে এতে সুলতান
আলাউদ্দিন হোসেন শাহ এর নামের উল্লেখ থেকে এটা সুস্পষ্ট যে, মসজিদটি তার
রাজত্বকালের (১৪৯৪-১৫১৯) কোন এক সময় নির্মিত।
ছোট সোনামসজিদের মূল ফটক
ছোট সোনামসজিদের প্রস্তর লিপি:
মসজিদের
দরজাগুলোর প্রান্তদেশ বলিষ্ঠ শোভাবর্ধক রেখা দিয়ে ঘেরা। কিন্তু খোদাই
কাজটি অগভীর এবং অট্টালিকাটির খুব নিকটে না পৌছলে এ খোদাই কাজ চোখে পড়ে না।
দরজাগুলোর মধ্যবর্তী কুলঙ্গীগুলোতেও রয়েছে একই অগভীর খোদাই। মধ্য দ্বারের
উপরস্থ লিপিটির অনুবাদঃ ‘দয়াময় ও করুণাময় আল্লাহ পাক উনার নামে। সর্বশক্তিমান
আল্লাহ পাক বলেন যে, আল্লাহ পাক ও বিচার দিনের উপর আর কাউকে ভয় করোনা।’
যারা আল্লাহ পাক উনার মসজিদ তৈরী করেন তারা শীঘ্রই পথ প্রদর্শিতদের অন্তর্ভূক্ত
হবে এবং হুযুর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন যে, আল্লাহ পাক উনার জন্য যে একটি মসজিদ নির্মাণ করে, তার
জন্য অনুরূপ একটি গৃহ বেহেস্তে তৈরী করা হবে। এ মসজিদের নির্মাণ কার্য
সুলতানগণের সুলতান, সৈয়দগণের সৈয়দ, পবিত্রতার উৎস, যিনি মুসলমান নর-নারীর
উপর দয়া করেন, যিনি সত্য কথা ও সৎ কাজের প্রশংসা করেন, যিনি ইসলাম ও
মুসলমানদের রক্ষক, সেই আলাউদ্দুনীয়া ওয়াদ্দীন আবুল মুযাফ্ফর হোসেন শাহ্
সুলতান আল হোসাইনী রহমতুল্লাহি আলাইহি, (আল্লাহ উনার রাজ্য ও শাসন চিরস্থায়ী করেন) এর
রাজত্বকালে সংঘটিত হয়। খালেছ ও আন্তরিক উদ্দেশ্য প্রণোদিত হয়ে এবং আল্লাহ পাক উনার
উপর বিশ্বাস রেখে ওয়ালী মনসুর, কর্তৃক জামে মসজিদ নির্মিত হয়। সর্বশক্তিমান
আল্লাহ পাক ইহকাল ও পরকাল উভয়স্থানে তাকে সাহায্য করেন। এর শুভ তারিখ হচ্ছে
আল্লাহ পাক উনার রহমতের মাস রজবের ১৪ তারিখ। এর মূল্য এবং মর্যাদা বর্ধিত হোক।’’ এই
লিপিটির মধ্যম লাইনে তিনটি শোভাবর্ধক বৃত্ত রয়েছে। প্রত্যেকটির মধ্যে
রয়েছে আল্লাহ পাক উনার নাম মুবারক। মধ্যম বৃত্তটির মধ্যে রয়েছে ‘ইয়া আল্লাহ’ ( আল্লাহ)
ডানদিকে বৃত্তটির মধ্যে রয়েছে ‘ইয়া হাফিয’ ( রক্ষক) এবং বামদিকের
বৃত্তটির মধ্যে ‘ইয়া রহিম’ ( দয়াময়)। অলংকরণের ক্ষেত্রে যে সোনালি গিল্টির
ব্যবহার থেকে এর ‘সোনা মসজিদ’ নামকরণ হয়েছে তা এখন আর নেই। মসজিদ
প্রাঙ্গণের চতুদিকে পূর্বে একটি বহির্দেয়াল ছিল। পূর্ব পশ্চিমে ৪২ মিটার
এবং উত্তর-দক্ষিণে ৪৩ মিটার লম্বা এ বহির্দেয়ালের পূর্বদিকের মধ্যবর্তী
স্থানে একটি ফটক ছিল। শুধু ফটকটি ছাড়া সমগ্র বহির্দেয়াল এখন সম্পূর্ণরূপে
নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। তবে স্থানে স্থানে এখনও এর চিহ্ন সুস্পষ্ট। বর্তমানে
মূল চৌহদ্দি দেওয়ালের স্থলে কাঁটাতারের বেড়া বসানো হয়েছে। স্থানীয় ভাবে
জানা যায় যে, ফটকের নিকটে এবং দিঘির দক্ষিণপাড়ে এক সময় সোপানবিশিষ্ট একটি
পাকা ঘাট ছিল।
মসজিদটি
ইট ও পাথরে নির্মিত। এ মসজিদের মূল ইমারত আয়তাকার এবং বাইরের দিকে
উত্তর-দক্ষিণে ২৫.১ মিটার এবং পূর্ব-পশ্চিমে ১৫.৯ মিটার। চারটি দেওয়ালই
বাইরের দিকে এবং কিছুটা অভ্যন্তরভাগেও গ্রানাইট পাথরখন্ডের আস্তরন শোভিত।
১৮৯৭ সালে প্রলয়ঙ্করী ভূমিকম্পে ধ্বংসলীলার পর সংস্কার কাজের সময় পশ্চিম
দেয়ালের দক্ষিণ অংশে পাথরের আস্তরন অপসারিত হয়েছে। মসজিদের বাইরের দিকে চার
কোণে চারটি বহুভূজাকৃতির বুরুজের সাহায্যে কোণগুলিকে মজবুত করা হয়েছে। এ
বহুভুজ বুরুজের নয়টি অংশ বাইরে থেকে দেখা যায়। পেছন দেয়ালের মধ্যবর্তীস্থলে
কেন্দ্রীয় মিহরাবের বাইরের দিকে আয়তাকার একটি বর্ধিত অংশ রয়েছে।
কার্নিসগুলো ধনুকের মতো বাঁকানো এবং ছাদ থেকে বৃষ্টির পানি নিস্কাশনের জন্য
ছাদের কিনারায় পাথরের নালি বসানো আছে। মসজিদের পূর্বদিকের সম্মুখভাগে
পাঁচটি এবং উত্তর ও দক্ষিণ দেয়ালে তিনটি করে প্রবেশদ্বার রয়েছে। পূর্ব
দেয়ালের খিলানযুক্ত প্রবেশদ্বার বরাবর পশ্চিম দেয়ালের অভ্যন্তরে রয়েছে
পাঁচটি অর্ধবৃত্তাকার মিহরাব। অধিকাংশ মিহরাবের পাথর সরিয়ে নেয়ার ফলে এখন
সমগ্র পশ্চিম দেওয়াল অনাবৃত হয়ে পড়েছে; অথচ এক সময় এ দেয়ালই ছিল মসজিদের
সর্বাপেক্ষা সুদৃশ্য অংশ।
মসজিদের ২১.২ মি Í
১২.২ মি পরিমাপের অভ্যন্তরভাগ প্রতি সারিতে চারটি করে দুসারি প্রস্তর
স্তম্ভ দ্বারা উত্তর দক্ষিণে লম্বা তিন স্তরে বিভক্ত। একটি বিস্তৃত
কেন্দ্রীয় নেভ স্তরগুলোকে সমান দুভাগে বিভক্ত করেছে। প্রতি ভাগে রয়েছে ৩.৫
মিটার বাহুবিশিষ্ট ছয়টি সমান বর্গাকার ইউনিট। মসজিদের অভ্যন্তরভাগে তাই মোট
পনেরোটি ইউনিট রয়েছে যার মধ্যে তিনটি আয়তাকার ইউনিট চৌচালা খিলান ছাদ
দ্বারা আচ্ছাদিত। বাকি বারোটি বর্গাকৃতি ইউনিটের প্রত্যেকটি উল্টানো
পানপাত্র আকৃতির গম্বুজ দ্বারা আচ্ছাদিত। এগুলোর সবই স্বতন্ত্র পাথরের
স্তম্ভ ও ভবনের সঙ্গে যুক্ত স্তম্ভ শীর্ষে বসানো বিচ্ছুরিত
খিলানের উপর স্থাপিত। কিন্তু ইউনিটগুলোর খিলানের মধ্যবর্তী উপরের কোণগুলি
গম্বুজ বসানোর উপযোগী করার জন্য করবেল পদ্ধতিতে ইটের পেন্ডেন্টিভ দ্বারা
বন্ধ করা হয়েছে। মসজিদের উত্তর-পশ্চিম কোণে উপরিভাগে দোতলার কায়দায় নির্মিত
একটি রাজকীয় গ্যালারি রয়েছে। গ্যালিরিটি এখনও ধ্বংসপ্রায় অবস্থায়
বিদ্যমান। মসজিদের উত্তর-পশ্চিম কোণে ছিল গ্যালারির প্রবেশপথ। দরজার সঙ্গে
সংযুক্ত একটি সোপানযুক্ত প্লাটফর্ম হয়ে গ্যালারিতে পৌঁছাত। গ্যালারির
সম্মুখভাগে রয়েছে একটি মিহরাব।
মসজিদের
অলংকরণের ক্ষেত্রে খোদাইকৃত পাথর, ইটের বিন্যাস, পোড়ামাটির ফলকের গিল্টি ও
চকচকে টালি ব্যবহৃত হয়েছে। তবে এগুলোর ভেতর প্রাধান্য পেয়েছে খোদাইকৃত
পাথর। ক্রাইটন ও কানিংহাম মসজিদটির ছাদের উপর পনেরোটি গম্বুজ ও খিলান ছাদের
সবগুলোই গিল্টি করা দেখতে পান। কিন্তু বর্তমানে গিল্টির কোন চিহ্ন নেই।
পাথর খোদাইয়ের নকশার ধরন নির্বাচন করা হয়েছে সংশ্লিষ্ট পরিসরের উপযোগিতা
অনুযায়ী। যেমন, প্যানেলের কিনারগুলিতে করা হয়েছে লতাপাতার নকশা এবং এদের
অভ্যন্তরভাগে হিন্দু আমলের শিকল ও ঘন্টার মোটিফ অনুসরনে বিভিন্ন ধরনের
ঝুলন্তরীতি অনুসরণ করা হয়েছে। খিলানের স্প্যান্ড্রিল ও ফ্রেমের উপরের
স্থানগুলি আকর্ষনীয় অলংকরণরীতিতে ভিন্ন ভিন্ন ভাবে খোদাই করা গোলাপ দিয়ে
ভরাট করা হয়েছে। গম্বুজ ও খিলান ছাদের অভ্যন্তর ভাগে পোড়ামাটির ফলক দিয়ে
অলংকৃত; তবে খিলান ছাদের অলংকরণ করা হয়েছে স্থানীয় কুঁড়েঘরের বাঁশের
ফ্রেমের অনুকরণে। সবচেয়ে লক্ষ্যণীয় অলংকরণ হলো কোণের বুরুজের খোদাইকৃত
পাথরের বেষ্টনী এবং দ্বারপথ ও ফ্রেমের উপরে বসানো পাথরের কার্নিস ও অলংকরণ
রেখা। উল্লেখ্য, সম্মুখের সবগুলি খিলানপথ ও মিহ্রাবের খিলানগুলি ছিল
খাঁজবিশিষ্ট এবং এগুলো অনেকাংশে এ মসজিদের সৌন্দর্য বৃদ্ধি করেছিল।
মসজিদের
প্রবেশদ্বারের মতোই পূর্ব দিকের ফটকে একসময় বিভিন্ন নকশা খোদাইকৃত
প্রস্ত্তর ফলকের আস্তরণ ছিল। কিন্তু এখানে সেখানে বিক্ষিপ্ত কিছু গোলাপ
নকশা ছাড়া এসব অলংকরণের তেমন কিছই এখন আর নেই। ফটকের ১৪.৫ মিটার পূর্বদিকে
একটি পাথরের প্লাটফর্ম রয়েছে যার আয়তন উত্তর-দক্ষিণে ৪.২ মিটার,
পূর্ব-পশ্চিমে ৬.২ মিটার এবং উচ্চতা ১ মিটার। এর চার কোনে রয়েছে একটি করে
প্রস্ত্তর স্তম্ভ। প্লাটফর্মের পরে কয়েকটি উর্ধ্বমুখী আয়তাকার ধাপ আছে এবং এ
ধাপসমূহের পরিধি উপরের দিকে ক্রমশ হ্রাস হয়ে এসেছে। দুটি সমাধিতে রয়েছে
কুরআন শরীফের আয়াত ও আল্লাহ পাক উনার কতিপয় নাম মুবারক সম্বলিত অগ্রভাগ সরু পিপাকৃতির পাথরের
সমাধিফলক। এখানে কারা সমাহিত আছেন তা সঠিক জানা যায়নি। কানিংহাম সমাধি
দুটিকে মসজিদের নির্মাতা ওয়ালী মুহম্মদ ও তার পিতা আলীর বলে মনে করেন। ছোট
সোনা মসিজিদের দৃষ্টিনন্দন রূপ অনেকটা হ্রাস পেলেও অদ্যাবধি এটি
গৌড়-লখনৌতির সবচেয়ে আকর্ষণীয় ইমারত এবং এ এলাকায় আগত দর্শনার্থীদের জন্য
সর্বাধিক কাঙ্ক্ষিত নিদর্শন।
তথ্যসূত্র: ইন্টারনেট
No comments:
Post a Comment