Friday, March 15, 2013

কথিত ভালো স্কুলের হুজুগ!



বছর শেষ হলেই বহু অভিভাবকের মাথা গরম হয়ে যায় কিভাবে তার শিশু সন্তানকে একটি ভালো(?) স্কুলে ভর্তি করবে, এ দুশ্চিন্তায়এজন্য অনেকে ডোনেশন-এর নামে লক্ষ লক্ষ টাকা ঘুষও দেয়অনেকে শিশুকে লক্ষ লক্ষ টাকা খরচ করে কোচিং করায়যে শিশুর এখনো ছোটাছুটির বা দুরন্তপনার বয়সই হয়নি, তাকে নিয়ে হাজার হাজার শিশুর সাথে প্রতিযোগিতার অমসৃণ ময়দানে নামিয়ে দেয়া কতটা সুস্থ সমাজের চিত্র বহন করছে, তা কেউ ভাবছে নাসত্যিকার অর্থে এটি একটি মারাত্মক অসুস্থ প্রতিযোগিতা
অভিভাবকরা কথিত ভালো স্কুলবলতে বুঝে, যে স্কুলের গড়পড়তা ফলাফল ভালো অর্থা এ+পাওয়াদের সংখ্যা বেশিঅথচ ভালো স্কুল-কলেজের প্রকৃত রহস্য নিয়ে অভিভাবকদের কাউকে চিন্তা করতে দেখি নাকথিত ভালো স্কুল-কলেজগুলো বেছে বেছে তুখোড় মেধাবী শিক্ষার্থী ভর্তি করায় বলেই তাদের ফলাফল ভালো হয়কিন্তু দুনিয়ামুখী অভিভাবকরা মনে করে যে- তারা ভালো পড়ায় বলেই হয়তো তাদের ছাত্র-ছাত্রীরা ঈর্ষণীয় ফলাফল করেকিন্তু এটা একটা নিরেট ভুল ধারণা
 
কথিত ভালো স্কুল-কলেজগুলি যদি বেছে বেছে সাধারণ শিক্ষার্থীদের ভর্তি করে ভালো ফলাফল দেখাতে পারত, তবেই তাদেরকে সত্যিকারের ভালো স্কুল-কলেজ বলা যেততথাকথিত ভালো স্কুল-কলেজের আরেকটি দোষ হলো এরা হররোজ এক গাড়ি করে বাড়িরকাজ দেয়, যা সামালাতে অভিভাবকদের বাড়িতে টিউটর রাখতে, কয়েক জায়গায় কোচিং করাসহ আরো নানারকম ব্যতিব্যস্ত হতে হয়বিশেষত একেবারে ছোট ক্লাশে বা কিন্ডার গার্টেনের শিশুদের পড়ার মাত্রাতিরিক্ত চাপে শিক্ষার প্রতি বাচ্চাদের আগ্রহ সৃষ্টি না হয়ে, বরং তাদের মনে বিতৃষ্ণা ও ভীতি ভর করে বসেবিষয়টি দেশের নতুন প্রজন্মকে সুনাগরিক করে গড়ে তোলার পথে একটি অলঙ্ঘনীয় বাধা হিসেবে কাজ করে
 বহু সাধারণ ফ্যামিলির অভিভাবকের আশা, কথিত ভালো স্কুলে যেহেতু মন্ত্রী, এমপি, শিল্পপতি, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, সচিব, জেনারেল, জজ, ব্যারিস্টার প্রভৃতি কথিত অভিজাত পরিবারের ছেলে-মেয়েরা পড়াশোনা করে, তাই ওদের সাথে বুন্ধত্ব হওয়ার মাধ্যমে তাদের ছেলে-মেয়েরাও এক লাফে জাতে উঠে যাবেএর চেয়ে নিচু মানসিকতা আর কি হতে পারে? বাস্তবে দেখা যায়, যে শিশুরা গাড়িতে করে স্কুলে আসে, সে কিন্তু গাড়িতে করে আসা অন্য শিশুদের সাথেই বন্ধুত্ব করেহেঁটে আসা বা রিকশায় করে স্কুলে আসা শিশুদের সাথে তারা মেলামেশাই করে নাপবিত্র কুরআন শরীফ ও পবিত্র হাদীছ শরীফ উনাদের নছীহত মুবারক অনুযায়ী মুসলমানদেরকে সবসময় ক্ষমতাশালী এবং বিত্তশালীদের সাথে দহরম-মহরম সম্পর্ক গড়তে নিরুসাহিত করা হয়েছেক্ষমতাশালী এবং বিত্তশালীদের তথা আমীর-উমরাদের থেকে দূরে থাকতে নির্দেশ দেয়া হয়েছেকেননা পৃথিবীতে যত অপকর্ম হয়ে থাকে, তার বেশির ভাগই করে থাকে এই শ্রেণীর লোকেরাগল্প-উপন্যাসের কল্প-কাহিনীতে যতই ধনী-গরিবের মধ্যে মিল-মুহব্বত ঘটে যাক না কেন, বাস্তবে তা একেবারেই অকল্পনীয়পারস্যের বিশ্বখ্যাত বুযূর্গ কবি হযরত শায়েখ সাদী রহমতুল্লাহি আলাইহি তিনি বলেছেন, ‘বাঘের সাথে বন্ধুত্বের কারণে শেয়ালের যেমন বিনা শ্রমে খাবার জুটে যায়, তেমনি আবার বাঘের খেয়ালী থাপ্পড়ে শেয়ালকে আকস্মা প্রাণও হারাতে হয়
আফসোসের ব্যাপার হলো- অধিকাংশ অভিভাবকেরই একমাত্র চিন্তা থাকে কিভাবে তার সন্তানকে ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার-জজ-ব্যারিস্টার বানাবেঅন্যদিকে তার সন্তান সত্যিকারের মানুষের মতো মানুষ হবে কিভাবে, আল্লাহওয়ালা হবে কিভাবে, পরহেজগার-মুত্তাকী হবে কিভাবে, দেশপ্রেমিক হবে কিভাবে- এই চিন্তা করে এমন অভিভাবক খুঁজে পাওয়া দুষ্করএটা একটা অতীব দুঃখজনক হুজুগে পরিণত হয়েছেঅথচ প্রতিটি অভিভাবকের মনে রাখা উচিত- তার সন্তান যদি মহান আল্লাহ পাক উনাকে চিনতে পারে; মহান আল্লাহ পাক উনার রসূল, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার অনুসারী হয়; ওলীআল্লাহ উনাদেরকে উসীলা ধরে অর্থা ওলীআল্লাহ উনার মাধ্যমে মহান আল্লাহ পাক উনার ও হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনাদের নিদের্শিত মত-পথে স-সুন্দর-পবিত্র জীবনযাপনে আগ্রহী হয়; তবে হোক সে রিকশাচালক কিংবা চানাচুর বিক্রেতা, মহান আল্লাহ পাক উনার কাছে তার মর্যাদা কোটি কোটি অস ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার-জজ-ব্যারিস্টারের চাইতেও অনেক অনেক বেশি
স্বভাবতই মানুষ মাত্রই ভুল-ত্রুটি, লোভ-লালসা, অলসতা, দায়িত্বহীনতা, পক্ষপাতিত্ব ইত্যাদি দোষ কিছু না কিছু থেকে থাকেসেক্ষেত্রে কোনো বিচারপ্রার্থী যদি কোনো বিচারকের কাছে ন্যায়বিচার হতে বঞ্চিত হয়, তবে সেই বিচারককে জাহান্নামের আগুনে জ্বলতে হবেএকই কারণে একজন ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ারেরও একই পরিণতি বরণ করা বিচিত্র কিছু নয়
মূলত, পড়াশুনা নিজের কাছেপড়াশুনা করতে হবে নিজেকেই, স্কুল-কলেজ-মাদরাসা নিয়ামক বা প্রভাবক মাত্রভালো ফলাফলের ক্ষেত্রে স্কুলের ভূমিকা আসলেই কমআপনার সন্তান যদি মেধাবী হয়, তাকে বেশি বেশি পড়তে বলেন, পর্যাপ্ত বই কিনে দেন, সামর্থ্য থাকলে সহায়ক হিসেবে টিউটর রাখেতে পারেন, নিজে সন্তানের পড়া-লেখার খোঁজ-খবর রাখুন, সাহ দিন, মুসলিম মনীষী উনাদের জীবনচরিত শুনানÑ সে ভালো ফলাফল করবেইতা সে যত সাধারণ আর অখ্যাত স্কুলেই পড়ুক না কেন
বাস্তবে একটু খোঁজ নিলেই দেখতে পাবেন, ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ এবং বুয়েটের মতো মেধাবীদের আখড়ায় কথিত নামকরা স্কুলগুলির অনেক ছাত্রও চান্স পায় নাআবার নিজের মেধার গুণে অখ্যাত স্কুলগুলোর অনেক ছাত্রও চান্স পেয়ে যায়
মনীষীরা বলেছেন, মেধা/প্রতিভা হলো ছাই চাপা আগুনশত চেষ্টা করেও তাকে চেপে রাখা যায় না; আপন গুণেই আপনার সন্তান সমাজে তার যোগ্য আসন গড়ে নিবেতাই তথাকথিত ভালো স্কুলে ভর্তি না করে আপনার বাসা থেকে সবচেয়ে কাছে যে স্কুলটি আছে তাতেই আপনার সন্তানকে ভর্তি করানভালো স্কুলের নামে দূরের কোনো স্কুলে রোজ আসা-যাওয়াতে অযথা সময়ের অপচয়, এনার্জি লস, পয়সা নষ্ট, স্বাস্থ্যহানি, সর্বোপরি গাড়িচাপা পড়ে দুর্ঘটনায় মৃত্যুর সম্ভাবনাও আছেসুতরাং সচেতন হোনদুনিয়াপ্রীতি ছেড়ে পরকালমুখী হন

No comments:

Post a Comment