Sunday, March 3, 2013

হরতালে আরও বেপরোয়া জামাত ॥ * থানা ও ফাঁড়িতে হামলা * ছয় জেলায় জামাতী তা-বে পুলিশসহ নিহত ২৬ * জামাত-শিবিরের নৃশংসতা দেখল বগুড়াবাসী


মওদুদীবাদী ধর্মব্যবসায়ী জামাতের ডাকা ৪৮ ঘণ্টার হরতালের প্রথম দিনে ছয় জেলায় পুলিশ কনস্টেবলসহ ২৫ জন নিহত ও গুলিবিদ্ধসহ শতাধিক আহত হয়েছে। গতকাল রোববার সকাল থেকে জামাত-শিবিরের তা-বে পুলিশ, র‌্যাব, বিজিবি ও আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের সঙ্গে ধাওয়া পাল্টা-ধাওয়া ও সংঘর্ষে এ হত্যাকা-ের ঘটনা ঘটে।

এর মধ্যে বগুড়ায় ১৪, জয়পুরহাটের দুই উপজেলায় ৬, রাজশাহীর গোদাগাড়ীতে ৪, সাতক্ষীরায় ১, গাজীপুরের শ্রীপুরে ১, ঝিনাইদহের হরিণাকু-ুতে এক পুলিশ সদস্য নিহত হয়েছে। আহত হয়েছেন শতাধিক ব্যক্তি, যার মধ্যে গুলিবিদ্ধ হয়েছে কমপক্ষে ৩৭ জন। জামাতের ডাকা দু’দিনব্যাপী সকাল-সন্ধ্যা হরতালে প্রথমদিন এ সংখ্যক প্রাণহানির ঘটনা ঘটলো।
আমাদের জেলা প্রতিনিধি ও সংবাদদাতাদের পাঠানো খবরের ভিত্তিতে ডেস্ক প্রতিবেদন।
বগুড়া: গতকাল ইয়াওমুল আহাদি বা রোববার সকালে বগুড়ার শাজাহানপুর সেনানিবাস এলাকায় পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে জামাত। পরে তারা শাজাহানপুর থানায় হামলা চালাতে গেলে পুলি গুলি চালায়। এতে গুলিবিদ্ধ হয়ে শিশু ও নারীসহ ৪ জন নিহত হয়। আহত হয় ৩ জন। সকাল সাড়ে ৭টায় হতাহতের ঘটনার পর ক্যান্টেনমেন্ট এলাকায় অবস্থিত এ থানায় সেনাবাহিনী দুটি গাড়ি অবস্থান নেয়। পরে বগুড়া পৌর এলাকায় ১৪৪ ধারা জারি করা হয়।
এরপর মোকামতলা পুলিশ ফাঁড়িতে হামলা চালায় জামাত-শিবির। এ ঘটনায় পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে এক শিশুসহ ৪ জন নিহত হয়। এ ঘটনায় ২০-২৫ জন আহত হয়। এছাড়া বগুড়া শহরের বিভিন্ন স্থানে সংঘর্ষে পুলিশের গুলিতে নিহত হয়েছে ৩ জন।
রাজশাহী: রাজশাহীর গোদাগাড়ীতে জামাত-শিবির নেতাকর্মীদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষ, গোলাগুলি ও ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া হয়। এতে গুলিবিদ্ধ হয়ে শিশুসহ ৪ জন নিহত হয়েছে। এ ঘটনায় ৫ জন গুলিবিদ্ধসহ ৪০ জন আহত হয়েছে।
গতকাল সকাল ১০টায় হরতালের সমর্থনে মওদুদীবাদী জামাত নেতাকর্মীরা রাজশাহী মহাসড়ক অবরোধ করতে গেলে পুলিশ বাধা দেয়। তখন পুলিশে সঙ্গে তাদের ধাওয়া-পাল্টাধাওয়া ও সংঘর্ষ হয়। এ সময় হতাহতের ঘটনা ঘটে।
ঝিনাইদহ: বেলা পৌনে ১২টার দিকে হরতালে জামাত-শিবিরের সঙ্গে সংঘর্ষে ঝিনাইদহের হরিণাকু-ে এক পুলিশ সদস্য নিহত হয়েছে। এছাড়া ১০ পুলিশসহ আহত হয়েছে আরও ৫০ জন। নিহত পুলিশ সদস্যের নাম ওমর ফারুক।
জয়পুরহাট: জয়পুরহাট সদরের হিচমিতে জামাত-শিবিরের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষে গুলিবিদ্ধ হয়ে নাছির উদ্দিন (১৮) নামে এক শিবির কর্মী নিহত হয়েছে। নাছির পাঁচবিবির বাশপুরের বাসিন্দা। এ সময় আরও ৬ জন গুলিবিদ্ধ হয়েছে।
এছাড়া জেলার পাঁচবিবি সদরে জামাত-শিবিরের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষে গুলিবিদ্ধ হয়ে ৪ জন নিহত হয়েছে। এ ঘটনায় আরও ১৫ জন গুলিবিদ্ধ হয়েছে। নিহতরা হলো- পাঁচবিবির বড়মালিক গ্রামের জামাত কর্মী মাও. হাসিব উদ্দিন (৫০), আয়মার ফরমান আলী(৩০), সালাইপুরের আব্দুল হাকিম (৩২) ও কাশিয়া গ্রামের মফিজ উদ্দিনের ছেলে মহিদুল ইসলাম (৩২)। এছাড়া জয়পুরহাট সদরে একজন পুলিশের গুলিতে নিহত হয়েছে।
গাজীপুর: গাজীপুরের শ্রীপুর উপজেলা ছাত্রশিবির সভাপতি আব্দুর রাজ্জাক পিকেটিং করে পালানোর সময় ট্রাক চাপায় নিহত হয়েছে।
সাতক্ষীরা: শহরতলীর রইচপুর এলাকায় জামাত-শিবির ও বিজিবির সংঘর্ষে মাহবুবুর রহমান (৩০) নামে একজন নিহত হয়েছে। এ ঘটনায় তিনজন বিজিবি সদস্যসহ ৬ জন আহত হয়েছে।
জামাত-শিবিরের তা-ব দেখল বগুড়াবাসী :
বগুড়া সদর, শাজাহানপুর, নন্দীগ্রাম, দুপচাঁচিয়া ও শিবগঞ্জ উপজেলায় গতকাল রোববার দিনভর তা-ব চালিয়েছে জামাত-শিবিরের কর্মীরা। এ সময় তারা কয়েকটি এলাকায় সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন অফিস, আওয়ামী লীগের নেতার বাড়ি ও কার্যালয় ভাঙচুর করে সেখানে আগুন ধরিয়ে দেয়।
জামাত-শিবিরের কর্মীরা থানা ও ফাঁড়িতে হামলা চালালে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের সঙ্গে তাদের দফায় দফায় সংঘর্ষ হয়। এসব সহিংসতায় সদরে ৩ জন, শাজাহানপুরে ৪ জন ও শিবগঞ্জের মোকামতলায় ৪ জনসহ মোট ১৪ জন নিহত হয়েছে। বগুড়ার পুলিশ সুপার সামগ্রিক পরিস্থিতি ভয়াবহ বলে জানান।
শাজাহানপুরে চারজন নিহত : স্থানীয়, প্রত্যক্ষদর্শী ও পুলিশ সূত্র জানায়, সারা দেশে বাংলাদেশ জামাতের ডাকা ৪৮ ঘণ্টার হরতালের প্রথম দিন ছিল গতকাল। হরতালকে কেন্দ্র করে নাশকতা এড়াতে বগুড়া পৌর এলাকায় গতকাল সকাল সাতটা থেকে পরবর্তী নির্দেশ না দেয়া পর্যন্ত ১৪৪ ধারা জারি করা হয়। তবে শনিবার দিবাগত রাত থেকেই গুজব রটে- একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে ফাঁসির দ-াদেশ পাওয়া ধর্মব্যবসায়ী জামাতের নেতা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর চেহারা চাঁদে দেখা যাবে। রাত তিনটার দিকে বিভিন্ন মসজিদ থেকে মাইকিং করে সবাইকে বাইরে এসে তা দেখার জন্য আহ্বান জানানো হয়। এভাবে জড়ো হয়ে জামাত-শিবিরের কর্মীরা ভোর থেকেই মিছিল শুরু করে শহরের বিভিন্ন এলাকায় ভাঙচুর চালাতে থাকে।
গতকাল সকাল সাতটার দিকে জামাত-শিবিরের কর্মীরা শাজাহানপুর থানায় হামলা করে। বাধা দিতে গেলে পুলিশের সঙ্গে তাদের দফায় দফায় সংঘর্ষ হয়। তাদের ছত্রভঙ্গ করতে পুলিশ একপর্যায়ে গুলি ছোড়ে। এতে দু’জন নারীসহ চারজন নিহত হয়।
শাজাহানপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) নুরুল ইসলাম চারজন নিহত হওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করেছে। এ ব্যাপারে বগুড়া জেলা পুলিশ সুপার মোজাম্মেল হক বলেন, থানায় হামলা চালানো হলে পুলিশ আত্মরক্ষার্থে গুলি চালাতে বাধ্য হয়। গতকাল দুপুর দেড়টা থেকে শাজাহানপুর উপজেলা সদরে ১৪৪ ধারা জারি করা হয়।
শাজাহানপুরে সেনা টহল : শাজাহানপুর থানার পাশেই বগুড়া সেনানিবাস অবস্থিত। থানায় হামলার পর বগুড়া জেলা পুলিশ সুপার মোজাম্মেল হক ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে সেনা সহায়তার জন্য অনুরোধ জানান। জেলার সহকারী পুলিশ সুপার আশরাফুল ইসলাম বলেন, পুলিশ সুপার প্রয়োজনে সেনাবাহিনী চেয়ে অনুরোধ জানাতে পারেন। পরে ঢাকায় সেনা সদর দপ্তর সূত্র জানায়, বগুড়ার জেলা প্রশাসকের অনুরোধে শাজাহানপুরে সেনানিবাস এলাকা ও তার আশপাশে সেনা টহল বাড়ানো হয়। দুই প্লাটুন সেনা টহল দেয়।
সদর এলাকায় তিনজন নিহত : গতকাল সকাল সাড়ে সাতটার দিকে বগুড়া সদরের ইয়াকুবিয়া স্কুলের মোড়ে র‌্যাবের গাড়িতে হামলা চালায় হরতালের সমর্থকরা। র‌্যাব বাধা দিলে দুই পক্ষের মধ্যে দফায় দফায় সংঘর্ষ হয়। একপর্যায়ে র‌্যাবের সদস্যরা গুলি চালিয়ে তাদের ছত্রভঙ্গ করার চেষ্টা করেন। এ সময় তিনজন নিহত হয়। সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) সৈয়দ সহিদ আলম তিনজনের মৃত্যুর বিষয় নিশ্চিত করেছে।
ভাঙচুর-অগ্নিসংযোগ : গতকাল ভোর থেকেই বগুড়া শহর ও আশপাশের বিভিন্ন পাড়া-মহল্লা থেকে জামাত-শিবিরের কর্মীরা মিছিল বের করে নানা সহিংস কর্মকা- চালায়। সকাল আটটার দিকে জামাত-শিবিরের কর্মীরা বগুড়া রেলস্টেশনে আগুন ধরিয়ে দেয়। তারা জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মমতাজউদ্দিনের বাসায় হামলা চালিয়ে ভাঙচুর করে। এছাড়া তারা শহরে অবস্থিত এসএ পরিবহনের অফিস, করতোয়া কুরিয়ার সার্ভিসের অফিস ও এটিএন বাংলার কার্যালয়ে ভাঙচুর চালিয়ে সেখানে আগুন ধরিয়ে দেয়। একপর্যায়ে তারা ফুলবাড়ী পুলিশ ফাঁড়িতেও হামলা চালায়।
নন্দীগ্রামে সরকারি কার্যালয়ে আগুন-লুটপাট : নন্দীগ্রাম উপজেলায় আজ সকাল সাড়ে আটটার দিকে জামাত-শিবিরের নেতা-কর্মীরা হামলা চালিয়ে সরকারি বিভিন্ন কার্যালয়ে অগ্নিসংযোগ ও লুটপাট করে। এ সময় তারা ইউএনও এবং উপজেলা চেয়ারম্যানের সরকারি গাড়ি, উপজেলা চেয়ারম্যানের বাসভবন, উপজেলা যুবলীগের কার্যালয় ও আওয়ামী লীগের নেতাদের বাড়িতে অগ্নিসংযোগ করে। পরে তারা থানায় হামলার চেষ্টা করলে পুলিশ রাবারের গুলি ও কাঁদানে গ্যাসের শেল ছুড়ে তাদের ছত্রভঙ্গ করে দেয়। এছাড়া হরতালের সমর্থকেরা আন্তর্জাতিক বাণিজ্য মেলায় হামলা চালিয়ে ব্যাপক লুটপাট চালিয়েছে। ইউএনও আসিব আহসান ঘটনার সত্যতা নিশ্চিত করেছেন।
রেললাইন উপড়ে ফেলা হয় : গতকাল সকাল ১০টার দিকে সদরের কামারগাড়ি এলাকায় সরকারি আজিজুল হক কলেজের সামনে রেললাইন উপড়ে ফেলে হরতালের সমর্থকেরা। ওই ঘটনার পর সান্তাহার-লালমনিরহাট রেলপথে ট্রেন চলাচল বন্ধ হয়ে যায়।
দুপচাঁচিয়ায় থানা ঘেরাও : গতকাল ভোররাত থেকেই দুপচাঁচিয়ায় জামাত-শিবিরের কর্মীরা মিছিল ও পিকেটিং শুরু করে। গতকাল সকালে তারা সিও বাসস্ট্যান্ড এলাকায় বগুড়া-নওগাঁ সড়কের পাশে অবস্থিত আওয়ামী লীগের অফিসে আগুন লাগিয়ে পুড়িয়ে দেয়।
একপর্যায়ে জামাত-শিবিরের কর্মীরা লাঠিসোঁটা নিয়ে থানা ঘেরাও করে। থানার প্রধান ফটক তালাবদ্ধ থাকায় বিক্ষোভকারীরা থানার সামনে টায়ারে আগুন ধরিয়ে দেয় এবং থানা লক্ষ্য করে ইটপাটকেল ছোড়ে। গতকাল সকাল সাড়ে ১০টার দিকে জামাত-শিবিরের কর্মীরা উপজেলা সদরের পুরাতন বাজার এলাকায় আওয়ামী লীগের সভাপতির বাড়িতে অগ্নিসংযোগ করেন। এছাড়া তারা দুপচাঁচিয়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের সামনে তার ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান খান টাওয়ারে ভাঙচুর চালায়।
জামাত-শিবিরের কর্মীরা তালোড়া রেলস্টেশনের প্ল্যাটফর্মের সামনে রেললাইনের উপর কাঠের গুঁড়ি ও টায়ারে অগ্নিসংযোগ করে রেল চলাচল বন্ধ করে দেয়। দুপচাঁচিয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মনিরুল ইসলাম ঘটনার সত্যতা নিশ্চিত করেন।
শিবগঞ্জের মোকামতলায় ৪ জন নিহত : উপজেলার মোকামতলায় পুলিশের সঙ্গে জামাত-শিবিরের কর্মীদের সংঘর্ষে ৪ জন নিহত হয়েছে।
বর্তমান ও সাবেক সাংসদের বাসায় হামলা-ভাঙচুর : জামাত-শিবিরের কর্মীরা বগুড়া-১ আসনের আওয়ামী লীগ দলীয় সাংসদ আবদুল মান্নানের চকলোকমানস্থ বাসায় হামলা চালিয়ে ভাঙচুর করে। একই সময়ে সাবেক সাংসদ ও বগুড়ার প্রবীণ সাংবাদিক আমানুল্লাহ খানের বাসায়ও হামলা চালিয়ে ভাঙচুর করা হয়।
পুলিশের বক্তব্য : জেলার পুলিশ সুপার মোজাম্মেল হক বলেন, পরিস্থিতি ভয়াবহ। পুলিশই এখন জামাত-শিবিরের আক্রোশের লক্ষ্যবস্তু। শাজাহানপুর থানা ও কয়েকটি ফাঁড়িতে হামলা চালিয়ে তা-ব চালিয়েছে তারা। আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় আরও বিজিবি চাওয়া হয়েছে। (সূত্র : আল ইহসান)

No comments:

Post a Comment