বিশ্বজুড়ে নাগরিকদের চলাফেরার উপর সতর্কতা জারি করেছে যুক্তরাষ্ট্র। জানা গেছে, পুরো আগস্ট মাস জুড়েই বহাল থাকবে এ সতর্কাবস্থা। এর আগে গত বৃহস্পতিবার মুসলিম বিশ্বের ১৭টি দেশে অবস্থিত ২১টি দূতাবাস ও কনস্যুলেট রোববার বন্ধ রাখার ঘোষণা দেয় মার্কিন কর্তৃপক্ষ।
গোয়েন্দা সূত্রগুলোর বরাত দিয়ে মার্কিন সংবাদ মাধ্যম দাবি করেছে, “আল-কায়েদার হুমকিই যুক্তরাষ্ট্রকে উপর্যুপরি এ পদক্ষেপ নিতে বাধ্য করেছে। বিশেষ করে এ হুমকির নেপথ্যে রয়েছে আল-কায়েদার ইয়েমেনি শাখা। এর আগেও সংগঠনটি যুক্তরাষ্ট্রের যাত্রীবাহী বিমান ও কার্গো ফ্লাইট উড়িয়ে দেয়ার ষড়যন্ত্রের সঙ্গে জড়িত ছিলো।”
মার্কিন সংবাদ মাধ্যমের দাবি, সম্প্রতি শীর্ষ আল-কায়েদা নেতাদের পারস্পরিক ইলেক্ট্রনিক্স যোগাযোগ সনাক্ত করতে সক্ষম হয়েছে মার্কিন গোয়েন্দারা। মার্কিন গোয়েন্দাদের দাবি, ওই যোগাযোগ বার্তায় রমযান মাসে মধ্যপ্রাচ্য ও উত্তর আফ্রিকায় যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট অবস্থানে হামলা চালানোর বিষয়ে আলাপ হচ্ছিলো। মার্কিন সংবাদ মাধ্যম আরো দাবি করেছে, আবার অনেকেই মনে করছে, গত মঙ্গলবার আইমান আল জাওয়াহিরির একটি অডিও বক্তব্য প্রকাশের পরপরই নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ শুরু করে তার সহযোগী ও অনুসারীরা। মার্কিন গোয়েন্দারা ওই রকমই একটি যোগাযোগ সনাক্ত করতে সক্ষম হয়েছে বলেও ধারণা করছে মার্কিন বিশ্লেষকরা। জাওয়াহিরির কথিত ওই বার্তায় জাওয়াহিরি মুসলিম বিশ্বে সামরিক আগ্রাসন, পাকিস্তান ও ইয়েমেনে ড্রোন হামলায় মুসলিম মৃত্যুর ঘটনায় প্রতিশোধ নিতে মার্কিন স্বার্থে আঘাত হানার জন্য বিশ্বব্যাপী মুসলমানদের প্রতি আহবান জানিয়েছে।
মার্কিন সংবাদ মাধ্যমের দাবি, সন্ত্রাসবাদ (কথিত) বিশেষজ্ঞরা বলছে, ইয়েমেনে সংগঠনের সহকারী প্রধান আলি আল শারিরি হত্যার প্রতিশোধ নিতেই এ হামলা চালানোর পরিকল্পনা করছে আল-কায়েদা ইয়েমেন শাখা। ২০১২ সালে মার্কিন ড্রোন হামলায় তার মৃত্যু ঘটেছে বলে চলতি ২০১৩ সালের জুলাই মাসে নিশ্চিত করে সংগঠনটি। ইয়েমেনে সক্রিয় আল-কায়েদা পশ্চিমা মহলে ‘আল-কায়েদা ইন আরব পেনিনসুলা’ বা একিউএপি নামে পরিচিত। সন্ত্রাসবাদ (কথিত) বিশেষজ্ঞদের মতে, ড্রোন হামলায় বেশ কয়েকজন শীর্ষ নেতা মারা গেলেও একিউএপি এখনও পশ্চিমা স্বার্থে ব্যাপক বিধ্বংসী হামলা চালাতে সক্ষম। গুয়ানতানামো বে’র সাবেক বন্দী আলি আল শারিরি মারা গেলেও একিউএপি’র বোমা বিশেষজ্ঞ ইব্রাহিম হাসান আল আসিরি এখনও বেঁচে আছে। গত এক সপ্তাহে তাকে লক্ষ্য করে তিন তিন বার ড্রোন হামলা চালানো হলেও বেঁচে যায় সে।
মার্কিন সংবাদ মাধ্যমের দাবি, বিশ্বের অন্যান্য অঞ্চলেও আল-কায়েদার সহযোগী সংগঠনগুলোর শক্তি বেড়ে গেছে গত কয়েক বছরে। এ ব্যাপারে জর্জটাউন বিশ্ববিদ্যালয়ের (কথিত) সন্ত্রাসবাদ বিষয়ক বিশেষজ্ঞ ব্রুস হফম্যান বলেছে, ‘উত্তর আফ্রিকা ও মধ্যপ্রাচ্য জুড়ে আল-কায়েদা ও এর সহযোগী সংগঠনগুলোর শক্তি-সামর্থ্য গত কয়েক বছরে অনেক বেড়েছে।’ সম্প্রতি ইরাক ও লিবিয়ায় কারাগার থেকে সহযোগীদের বের করে নিতে চালানো ভয়াবহ হামলার কথা উল্লেখ করে সে বলেছে, বিধ্বংসী অস্ত্র সংগ্রহে সমর্থ হওয়ার পাশাপাশি আত্মঘাতী হামলা চালানোর সামর্থ্যও বৃদ্ধি পেয়েছে আল-কায়েদার।
যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের ইস্যু করা হঁশিয়ারিতে মার্কিন নাগরিকদের কোনো বিশেষ দেশে ভ্রমণের ক্ষেত্রে নিষেধ করা হয়নি। মূলত, মধ্যপ্রাচ্য ও উত্তর আফ্রিকায় তথা মুসলিম দেশগুলো ভ্রমণের সময় মার্কিন নাগরিকদের বিশেষভাবে সতর্ক থাকার আহবান জানানো হয় ওই বার্তায়। এর আগে সর্বশেষ গত ২০১১ সালের অক্টোবর মাসে বিশ্বজুড়ে নাগরিকদের ভ্রমণের ক্ষেত্রে সতর্কতা জারি করেছিলো যুক্তরাষ্ট্র। এবারের মত এত বিস্তৃত পরিসরে না হলেও মাঝে অবশ্য কয়েকবার হালকা সতর্কতা জারি করা হয়। তবে এবারের হুমকির উপর এত গুরুত্বারোপ যুক্তরাষ্ট্রের ‘বেন গাজীর’ ঘটনা থেকে শিক্ষাগ্রহণ হিসেবেই উল্লেখ করেছে হফম্যান। তার মতে, বেনগাজীর মার্কিন কনস্যুলেটে হামলায় চার কূটনীতিক নিহত হওয়ার ঘটনাটিই যুক্তরাষ্ট্রকে অধিক তৎপর (আগ্রাসী) হতে বাধ্য করেছে। হামলায় নিহত হয়েছিলো লিবিয়ায় নিযুক্ত যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন রাষ্ট্রদূত ক্রিস্টোফার স্টিভেন্স। এ ঘটনায় আগাম গোয়েন্দা তথ্য পেতে ব্যর্থতার অভিযোগে ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়তে হয় ওবামা প্রশাসনকে।
মার্কিন সংবাদ মাধ্যম জানায়- বিষয়টি নিশ্চিত করে জেনারেল মার্ঢিন ডেম্পসিও। মার্কিন জয়েন্ট চিফ অব স্টাফের চেয়ারম্যান জেনারেল মার্টিন ডেম্পসি বলেছে, ‘গুরুতর হুমকির পরিপ্রেক্ষিতেই নাগরিকদের জন্য এই ভ্রমণ সতর্কতা এবং দূতাবাস বন্ধের পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে।’ কর্তৃপক্ষ বিষয়টিকে অত্যন্ত গুরুত্ব দিচ্ছে বলেও জানায় সে। তবে হামলার সম্ভাব্য লক্ষ্যবস্তু নিয়ে এখনো অন্ধকারে যুক্তরাষ্ট্র। মার্কিন গোয়েন্দারাও স্বীকার করেছে তারা জানে না ঠিক কোথায় হামলা হতে পারে। তবে মধ্যপ্রাচ্য ও উত্তর আফ্রিকার কোথাও এটা হওয়ার সম্ভাবনা বলেই ধারণা করছে তারা।
অবশ্য অজ্ঞাত গোয়েন্দা সূত্রের উদ্ধৃতি দিয়ে সিএনএন জানিয়েছে, মুসলমানদের পবিত্র দিন ২৭ রমযানকে সামনে রেখে রবি থেকে মঙ্গলবারের মধ্যেই এ হামলা চালানো হতে পারে বলে আভাস পেয়েছে মার্কিন গোয়েন্দারা।
এদিকে আল-কায়েদার হুমকিতে শুধু যুক্তরাষ্ট্রই নয়, অস্থির ব্রিটেনও। ব্রিটিশ পররাষ্ট্র দপ্তরের একজন মুখপাত্র জানিয়েছে, রোববার ও সোমবার ইয়েমেনে দূতাবাস বন্ধ ঘোষণা করেছে তারা। ইয়েমেনের রাজধানী সানায় অবস্থিত ওই দূতাবাস থেকে প্রয়োজনীয় ছাড়া অপরাপর কর্মীদের সরিয়ে নেয়া হয়েছে বলেও জানায় সে। এ সতর্কতা রমযানের শেষ দিনগুলো থেকে ঈদ পর্যন্ত বহাল থাকবে বলে জানায় সে।
আল-কায়েদার হুমকি থেকে মার্কিন নাগরিকদের রক্ষা করতে প্রয়োজনীয় সব পদক্ষেপের ঘোষণা দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা। ওবামা সর্বশেষ পরিস্থিতি সম্পর্কে অবগত আছে বলেও জানায় হোয়াইট হাউজের সূত্রগুলো। নিরাপত্তা হুমকির এ বিষয়টিতে আলোড়ন তুলেছে যুক্তরাষ্ট্রের রাজনৈতিক মহলেও। হাউজ অব রিপ্রেজেন্টিটিভসের ডেমোক্রাট দলীয় নেতা ন্যান্সি পেলোসি বলেছে, কংগ্রেস নেতারা হুমকির গুরুত্ব ও তীব্রতার বিষয়ে অবগত।
তবে আল-কায়েদার সম্ভাব্য হামলার আশঙ্কায় দূতাবাস বন্ধ থেকে শুরু করে যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকদের জন্য বিশ্বজুড়ে ভ্রমণ সতর্কতা জারির বিষয়টিকে অনেকেই দেখছেন অন্যভাবে।
তাদের বিশ্লেষণ হলো, সম্প্রতি স্নোডেনের তথ্য ফাঁসের ঘটনায় বেকায়দায় থাকা মার্কিন কর্তৃপক্ষের বিষয়টি থেকে মানুষের নজর অন্যদিকে সরানোর একটি অপচেষ্টা। জাতীয় নিরাপত্তার দোহাই দিয়ে মার্কিন নিরাপত্তা সংস্থাগুলো তাদের জনগণের উপর ব্যাপকভিত্তিতে নজরদারি পরিচালনা করছে, এমনকি ব্যক্তিগত গোপনীয়তাও ভঙ্গ করছে হরহামেশাই, এমন তথ্য সম্বলিত দলিলই ফাঁস করে সাবেক সিআইএ কর্মী অ্যাডওয়ার্ড স্নোডেন। এরপরই আলোড়ন সৃষ্টি হয় বিশ্বজুড়ে। প্রতিবাদে মুখর হয় মার্কিন নাগরিকরা।
মার্কিন নিরাপত্তা সংস্থাগুলো সামাজিক যোগাযোগ সাইট থেকে শুরু করে ব্যক্তিগত টেলিফোনেও আড়িপাতার মতো অবৈধ কা- ঘটিয়েছে বলে স্নোডেনের ফাঁস হওয়া তথ্যে প্রকাশ হয়। বিষয়টিতে বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়ে মার্কিন কর্তৃপক্ষ। বেকায়দায় পড়ে ওবামাও।
তাই অনেকে মনে করছেন ব্যক্তিগত গোপনীয়তা লঙ্ঘন নিয়ে সৃষ্ট বিতর্ককে ধামাচাপা দেয়ার একটা ভালো উপায় হতে পারে বিশ্বজুড়ে এই সতকর্তা জারি। আর এক্ষেত্রে অজুহাত হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে আল-কায়েদার সন্ত্রাসী হামলার আশঙ্কাকে।
একই সঙ্গে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের হানাদার কর্তৃপক্ষ যদি মানুষকে বোঝাতে সক্ষম হয় যে, ওই নজরদারির কারণেই আরও একটি সম্ভাব্য হামলা প্রচেষ্টা সম্পর্কে আগেভাগেই জানা গেছে, তবে সেক্ষেত্রে ছল-চাতুরী মার্কিন কর্তৃপক্ষ এ ব্যাপারে নিজেদের পক্ষে সাফাই গাওয়ার একটা ভালো অজুহাত পেয়ে যাবে, তা বলাইবাহুল্য।
No comments:
Post a Comment