ভূমিকা:
সমুদ্রের ঢেউ এসে আছড়ে পড়ছে দিগন্তরেখা ছুঁয়ে যাওয়া বিস্তৃত সৈকতের বুকে। ফেনিল নোনা পানিতে ভেজা তটরেখায় লাল কাঁকড়াদের ছুটাছুটি। খানিক দূরে ঝাউ বাগানের ভেতর দিয়ে বয়ে চলা বাতাসের শো শো আওয়াজ। ঝাউ গাছের ঝরা পাতাগুলো শুকনো বালুর উপর যেন কার্পেটের নরম বিছানা পেতে রেখেছে। এর মাঝে পাখিদের কলকাকলি সমুদ্রসৈকতের অপরূপ রূপকে করে তুলেছে আরও আকর্ষণীয়। এ হচ্ছে সোনারচরের সৌন্দর্যের এক ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র অংশ।
নদী আর সড়ক পথ পাড়ি দিয়ে সোনারচরে এসেই এর সৌন্দর্য উপলব্ধি করা যায়। অনেকেরই হয়তো ম্যানগ্রোভ বনের নির্জনে সৈকতের বালুতে গা এলিয়ে দিয়ে শোনা হয়নি সমুদ্রের কলকল ধ্বনি। বন্ধুদের হাত ধরাধরি করে ঝাউ বাগানের ভেতর দিয়ে হাঁটা হয়নি। চক্ষু মেলিয়া দেখা হয়নি ভেজা বালুতে লাল কাঁকড়াদের আঁকা অনাবিল সৌন্দর্যের আলপনা। দেখা হয়নি পিপাসা মেটাতে সমুদ্রের পানি পানে আসা বুনো মহিষ দলের পায়ের ছাপে সৈকতের বালুতে কেমন চিত্রপট অঙ্কিত হয়। এখানে বন-বাদারের সব বুনোরাই যেন সৈকতের সৌন্দর্য অনেকখানি বাড়িয়ে রেখেছে।
প্রকৃতির টানে:
সোনারচরের আকর্ষণ যেকোন মানুষকেই কাছে টানে। এখানে পা না ফেললে এটা বোঝার কোনো উপায় নেই। এখানে রয়েছে প্রায় দশ কিলোমিটার দীর্ঘ সমুদ্র সৈকত। সূর্যাস্ত আর সুর্যোদয়ের মনোরম দৃশ্য উপভোগ করা যায় একই স্থান থেকে। সমুদ্রে টেনে নেয়ার ভয় নেই এখানে। আড়াআড়ি সমুদ্র স্রোতের ফলে পানির নিম্নমুখী টান নেই। এর ফলে পর্যটকেরা এখানে থাকবেন নিরাপদে। সৈকতের গা ঘেঁষে জেগে থাকা ঝাউবন এখানকার সৌন্দর্য আরও অনেকখানি বাড়িয়ে দিয়েছে। আছে ম্যানগ্রোভ বন। হরিণ, বুনো মহিষ, মেছোবাঘ, বন্যশূকর, উদসহ নানা প্রজাতির প্রাণী রয়েছে এখানে।
দিনের শেষ আর সকালটাই সোনারচরের অন্যতম আকর্ষণ হয়ে আছে। কুয়াশার চাদরে ঢাকা পুব আকাশের দিগন্ত ছুঁয়ে উঁকি দেয় ভোরের নতুন সুর্য। শেষ বিকালে রক্তরঙ সূর্যটা রক্তিম আভা ছড়িয়ে অস্তাচলে পাড়ি জড়ায়। তখন সোনারচরের স্বর্ণময় রূপচ্ছটা নীল পানিকে স্বর্ণালী করে দেয়। গোধুলির আচ্ছন্নতায় মøান হয় সোনারচরের আলো। নিজের রূপের আয়নায় ঘোমটা টেনে আরেকটি নতুন সকালের অপেক্ষায় ঘুমিয়ে পড়ে সমুদ্রকোলে জেগে থাকা স্বর্ণখ- সোনারচর।
আয়তন ও আকৃতি:
ভূখ- পরিমাপের হিসাবে সোনারচরের আয়তন সাত হাজার একর। সাম্প্রতিককালে চরের পূর্বদিকে নতুন চর পড়ায় এই আয়তন দশ হাজারে উন্নীত হওয়ার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। চরের পশ্চিম দিকটা সামান্য ভাঙনের মুখে থাকলেও পূর্বদিকে অনেক বিস্তৃত হচ্ছে। আয়তন দিন দিন বাড়ছে। চরটি দেখতে অনেকটা বাদামের দানার আকৃতি। সোনারচর ও এর পার্শ্ববর্তী চর আন্ডার মাঝখানে একসময় বড় নদী ছিল। চর পড়ে সে নদী এখন ছোট হয়ে গেছে। শুকনো সময়ে পায়ে হেঁটেই পার হওয়া যায়। সোনারচর চ্যানেল সরু হয়ে গিয়ে বনের সৌন্দর্য আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। চরের পাশে রয়েছে বহু পুরনো ম্যানগ্রোভ বন। এটি বন বিভাগের চরমোন্তাজ রেঞ্জের সোনারচর বিটের আওতাধীন।
যাওয়ার পথ:
সোনারচরে সরাসরি সড়ক কিংবা নৌপথে সহজ যোগাযোগ ব্যবস্থা আজও গড়ে উঠেনি। পটুয়াখালী থেকে গলাচিপা হয়ে আগুনমুখা মোহনা, ডিগ্রি, বুড়াগৌরাঙ্গ ও দাঁড়ছিড়া নদী পাড়ি দিয়ে দু’পাশে ঘন ম্যানগ্রোভ বন। ট্রলার কিংবা লঞ্চযোগে আগুনমুখার মোহনা থেকে ঘণ্টা দুয়েক এগুলেই চোখে পড়বে মায়াবী দ্বীপ-চর তাপসী। তাপসীর বাঁকে পৌঁছাতেই সোনারচরের হাতছানি। তাপসী থেকে ৩০ মিনিটের পথ দক্ষিণে এগুলেই সোনারচর। স্পিডবোট নিয়েও যাওয়া যায় সোনারচরে। পটুয়াখালীর গলাচিপা লঞ্চঘাট থেকে স্পিড বোটে সোনারচরে যেতে সময় লাগে মাত্র দেড় ঘণ্টা। আবার কুয়াকাটা থেকে সমুদ্র পাড়ি দিয়ে সোনারচরে যাওয়া যায়, ইঞ্জিনচালিত ট্রলারে সময় লাগবে ঘণ্টা তিনেক।
থাকার জায়গা:
সোনারচরে রাত্রিযাপনের জন্য নিরাপদ আরামদায়ক ব্যবস্থা গড়ে উঠেনি। তবে প্রশাসনের উদ্যোগে পর্যটকদের জন্য নির্মাণ করা হয়েছে ছোট্ট তিন কক্ষের একটি বাংলো। রয়েছে বন বিভাগের ক্যাম্প। এসব স্থানে রাতে থাকার সুযোগ রয়েছে। চাইলে সূর্যাস্তের দৃশ্য দেখে ইঞ্জিন চালিত নৌকা বা ট্রলারে মাত্র আধাঘন্টার মধ্যে ইউনিয়ন সদর চরমোন্তাজে গিয়ে থাকার সুযোগ রয়েছে। সেখানে রয়েছে বন বিভাগ, বেসরকারি সংস্থা স্যাপ-বাংলাদেশ ও মহিলা উন্নয়ন সমিতির বাংলো।
নামকরণ:
সোনারচরে স্বর্ণ নেই, আছে স্বর্ণ রঙের বালু। সকাল কিংবা শেষ বিকেলের রোদের আলো চরের বেলাভূমিতে পড়লে দূর থেকে পুরো দ্বীপটাকে সোনালি রঙের থালার মতো মনে হয়। বালুর উপরে সূর্যের আলোয় চোখের দৃষ্টিতে সোনারঙ আভা ছড়িয়ে যায়। মনে হবে দ্বীপটিতে যেন কাঁচা সোনার প্রলেপ দেয়া হয়েছে। বিশেষ এই বৈশিষ্ট্যের কারণেই দ্বীপটির নাম ‘সোনারচর’ রাখা হয়েছে বলে ধারণা করা হয়। কারও মতে, এক সময়ে দ্বীপটিতে প্রচুর পরিমাণে সোনালী ধান জন্মাতো বলে এই নামকরণ হয়েছে। আবার অনেকে মৎস্য আহরণের ক্ষেত্র হিসাবে চরটিকে সোনারচর বলে অখ্যায়িত করেন।
সম্ভাবনার হাতছানি:
সোনারচরের নিকটবর্তী সাগর বাজারের স্থানীয় বাসিন্দাদের দাবি একটাই, যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন ঘটিয়ে এই চরের সম্ভাবনা জাগিয়ে তুলতে হবে। সোনারচরকে পর্যটনকেন্দ্র ঘোষণার দাবি জানিয়ে তারা বলেন, যথাযথ উদ্যোগ নেয়া হলে এটি হবে দেশের অন্যতম পর্যটন কেন্দ্র। এখানে পর্যটকদের ভিড় জমবে। সরকারের আয় হবে বিপুল পরিমাণ রাজস্ব। পর্যটকরা সোনারচরের পাশেই মৌডুবী, জাহাজমারা, তুফানিয়া ও শিবচরসহ আরো কয়েকটি দ্বীপের সৌন্দর্য উপভোগ করার সুযোগ পাবেন।
স্থানীয়রা বলেন, সোনারচরের সম্ভাবনা জাগিয়ে তুলতে হলে এই এলাকার সঙ্গে ভোলা হয়ে সড়ক যোগাযোগ স্থাপন করার উদ্যোগ ত্বরান্বিত করতে হবে। এরইমধ্যে এই পথে তিনটি ক্লোজার নির্মাণের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। এগুলোর কাজ সম্পন্ন হলে এই পথ যানবাহন চলাচল উপযোগী করতে হবে। সড়ক উন্নয়নের পথ ধরে এখানে দিতে হবে বিদ্যুৎ সংযোগ। এর মধ্য দিয়ে আরও বিকশিত হবে সোনারচর।
No comments:
Post a Comment