Monday, June 30, 2014

পবিত্র রমাদ্বান শরীফ উনার জরুরী মাসায়ালা-মাসায়িল ও দোয়াসমূহ


রোযার পরিচয় ও করণীয়:

সাধারণত রোযা বলতে ছুবহি ছাদিক্ব থেকে শুরু করে সূর্যাস্তের পূর্ব পর্যন্ত নির্জন অবস্থান ও পানাহার থেকে বিরত থাকাকে বুঝায়। তবে এর সাথে সাথে মিথ্যা, গীবত, চোগলখোরী, ঝগড়া-বিবাদ, মারামারি-কাটাকাটি, গালি-গালাজ, অশ্লীল-অশালীন, ফাসিক্বী ও নাফরমানিমূলক কাজ থেকে বিরত থাকতে হবে। কারণ, হাদীছ শরীফ-এ বর্ণিত রয়েছে- আল্লাহ পাক উনার হাবীব হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি ইরশাদ করেন, “যে ব্যক্তি রমাদ্বান শরীফ-এ খারাপ কাজ করে, শরাব পান করে, ব্যভিচার করে এমন ব্যক্তি রমাদ্বান শরীফ-এর রোযা রাখলেও তা কবুল হবে না। বরং আল্লাহ পাক উনার ফেরেশতাকুল, আসমানের সব অধিবাসী উনারা পরবর্তী রমাদ্বান শরীফ-এর আগ পর্যন্ত ওই ব্যক্তির উপর লা’নত বর্ষণ করতে থাকেন।” নাঊযুবিল্লাহ! (গুনইয়াতুত ত্বলিবীন)

মহিমান্বিত মাসসমূহের মধ্যে পবিত্র রমাদ্বান শরীফ অন্যতম। এ মাসের ইবাদত-বন্দেগীর ফযীলত অন্যান্য মাসের চেয়ে বহুগুণ বেশি। এ মাসে বেশি বেশি তওবা-ইস্তিগফার, ইবাদত-বন্দেগী করে তাক্বওয়া হাছিলের মাধ্যমে আল্লাহ পাক ও উনার হাবীব ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনাদের রেজামন্দি-সন্তুষ্টি হাছিল করাই সকলের দায়িত্ব-কর্তব্য। পবিত্র রমাদ্বান শরীফ-এ ইবাদতের ফযীলত সম্পর্কে হাদীছ শরীফ-এ ইরশাদ হয়েছে, “রমাদ্বান শরীফ-এ আদম সন্তানের প্রতিটি নেক আমল দশগুণ থেকে সাতাশ গুণ পর্যন্ত বাড়ানো হয়ে থাকে।” (বুখারী শরীফ ও মুসলিম শরীফ)
এ সম্পর্কে ইমাম-মুজতাহিদ রহমতুল্লাহি আলাইহিম উনারা বলেন, রোযা এমন একটি ইবাদত যার ছওয়াবের পরিমাণ একমাত্র আল্লাহ পাক এবং উনার হাবীব ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনারাই ভালো জানেন। আর তাই হাদীছে কুদসী শরীফ-এ ইরশাদ হয়েছে-
الصوم لى وانا اجزبه

অর্থ: “নিশ্চয়ই রোযা একমাত্র আমার জন্যই রাখা হয়, আর আমিই এর প্রতিদান দিবো।” সুবহানাল্লাহ!
সুতরাং মাহে রমাদ্বান শরীফ-এ প্রত্যেক মুসলমান নর-নারীর নিম্নবর্ণিত বিষয়াবলী আমল করা উচিত-
১. রোযা রাখা।
২. তারাবীহ নামায নিয়মিত আদায় করা।
৩. পাঁচ ওয়াক্ত নামায জামায়াতের সাথে (পুরুষ হলে) আদায় করা।
৪. কালামুল্লাহ শরীফ খতম করা বা বেশি বেশি ক্রুআন শরীফ তিলাওয়াত করা।
৫. যিকির-আযকার করা।
৬. হালাল উপার্জন করা বা হালাল খাদ্য গ্রহণ করা।
৭. মিথ্যা কথা না বলা
৮. হারাম কাজ থেকে বিরত থাকা।
৯. আওলিয়ায়ে কিরাম উনাদের ছোহবত ইখতিয়ার করা।
১০. খুরমা-খেজুর দিয়ে ইফতার শুরু করা ও সাহরী শেষ করা।
১১. গরীব-মিসকীনদের খাওয়ানো বা সাহরী-ইফতার করানো।
১২. বেশি বেশি দান ছদক্বা করা।
১৩. যাকাত আদায় করা।
১৪. সর্বপ্রকার অপছন্দনীয় কাজ থেকে বিরত থাকা।
১৫. প্রত্যেক ঘরে ঘরে রহমত-বরকতের জন্য অবশ্যই বেশি বেশি মীলাদ শরীফ-ক্বিয়াম শরীফ ও দুআর মাহফিলের ব্যবস্থা করা।
১৬. কাউকে কষ্ট না দেয়া।
১৭. হারাম গান-বাজনা পরিহার করে হামদ, না’ত, ক্বাছীদা শরীফ শ্রবণ করা।
১৮. অপ্রয়োজনীয় কথা থেকে বিরত থাকা। কেননা রোযাদারের চুপ থাকাটা তাসবীহ তুল্য।
১৯. দিনের বেলা প্রয়োজন বা পরিমাণ মতো ঘুমানো। কেননা রোযাদারের ঘুমও ইবাদত তুল্য।
২০. সঠিক সময়ে সতর্কতার সাথে সাহরী ও ইফতার করা।
২১. যাদের পক্ষে সম্ভব রমাদ্বান শরীফ-এর শেষ দশ দিন ই’তিকাফ করা। যা সুন্নতে মুয়াক্কাদায়ে কিফায়া।
২২. শেষ দশ দিন বিজোড় রাত্রিগুলোতে লাইলাতুল ক্বদর বা শবে ক্বদর তালাশ করা। সজাগ থেকে ইবাদত-বন্দেগী ও দুআ ইস্তিগফার করা।

মোট কথা, পূর্ণ এক মাস রোযা, ইবাদত-বন্দেগী, রিয়াযত-মাশাক্কাত, যিকির-ফিকির, ইলম অর্জনের মাধ্যমে তাক্বওয়া হাছিল করত আগামী দিনগুলোতেও একইভাবে তাক্বওয়ার দ্বারা আল্লাহ পাক ও উনার হাবীব ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনাদের মতে মত ও পথে পথ থাকার কোশেশ করাই সকলের দায়িত্ব-কর্তব্য।

রোযার প্রকারভেদ:

 রোযা মোট ছয় প্রকার। যথা- ১.ফরয, ২. ওয়াজিব, ৩. সুন্নত, ৪. মুস্তাহাব, ৫. মাকরূহ, ৬. হারাম।
ফরয রোযা:
পবিত্র রমাদ্বান শরীফ-এর এক মাস রোযা হচ্ছে ফরয রোযা।
ওয়াজিব রোযা:
মানত-এর রোযা।
নফল রোযার ক্বাযা, যা শুরু করার পর ফাসিদ (ভঙ্গ) হয়ে গিয়েছিলো।
বিভিন্ন কাফফারার রোযা।

সুন্নত রোযা:
পবিত্র আশূরা মিনাল মুহররম (দশই মুহররম) উপলক্ষে দুটি রোযা রাখা। অর্থাৎ ৯/১০ অথবা ১০/১১ তারিখে রোযা রাখা।
প্রতি মাসে তিনটি রোযা রাখা।
পহেলা রজব এর দিনে রোযা রাখা।
মি’রাজ শরীফ-এর দিনে রোযা রাখা।
শবে বরাত উপলক্ষে ১৫ই শা’বানে রোযা রাখা
শাওওয়াল মাসের ৬টি রোযা।
যিলহজ্জ মাসের ১-৯ তারিখ পর্যন্ত ৯টি রোযা।

মুস্তাহাব রোযা:
প্রতি আরবী মাসের ১৩, ১৪, ১৫ তারিখে রোযা রাখা।
প্রতি সপ্তাহের ইয়াওমুল ইছনাইনিল আযীম তথা সোমবার শরীফ এবং বৃহস্পতিবার রোযা রাখা।
যে পাঁচ দিন রোযা রাখা নিষিদ্ধ সে পাঁচ দিন ব্যতীত অন্যান্য যে কোন দিন রোযা রাখা।

মাকরূহ রোযা:
ইয়ামুশ শক অর্থাৎ চাঁদের ত্রিশ তারিখ দিনে রোযা রাখা সাধারণভাবে মাকরূহ।
এছাড়া আশুরা উপলক্ষে ১ দিন রোযা রাখা

হারাম রোযা:
পবিত্র ঈদুল ফিতর-এর দিন।
পবিত্র ঈদুল আদ্বহার দিন।
এবং ঈদুল আদ্বহা-এর দিনের পরবর্তী তিন দিন (১১,১২,১৩ই যিলহজ্জ তারিখে) রোযা রাখা হারাম।
বিঃ দ্রঃ সাইয়্যিদুল আ’ইয়াদ, সাইয়্যিদে ঈদে আ’যম, সাইয়্যিদে ঈদে আকবর, পবিত্র ঈদে মীলাদুননবী ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর দিন তথা ১২ই রবীউল আউয়াল শরীফ-এ রোযা না রাখাই উত্তম। কেননা তা হচ্ছে সকল ঈদের সেরা ঈদ। খুশি প্রকাশের দিন।

রোযার কতিপয় মাসালা-মাসায়িল:

 রোযা ফরয হওয়ার শর্তাবলী-
রোযা ফরয হওয়ার জন্য নিম্নবর্ণিত শর্তগুলো থাকা আবশ্যক-
১. মুসলমান হওয়া।
২. বালিগ হওয়া।
৩. জ্ঞান সম্পন্ন হওয়া।
৪. সুস্থ হওয়া।
৫. মুক্বীম হওয়া। অর্থাৎ মুসাফির না হওয়া, কেননা মুসাফিরের জন্য বাধ্যবাধকতা থাকেনা। তবে মুক্বীম হওয়ার পর অবশ্যই ক্বাযা আদায় করতে হবে।

যার উপর রোযা আদায় করা ফরয নয়:
১. মুসাফির এর জন্য রোযা আদায় করা ফরয নয়। তবে আদায় করাই উত্তম। মুক্বীম হওয়ার পর অবশ্যই ক্বাযা আদায় করতে হবে।
২. অসুস্থ ব্যাক্তির উপর রোযা আদায় করা ফরয নয়। তবে সুস্থ হলে ক্বাযা আদায় করতে হবে।
৩. মহিলাদের মাসিক স্বভাবিক মাজুরতা, সন্তান হওয়ার কারণে মাজুরতার সময় তাদের উপর রোযা ফরয নয় । তবে উভয় মাজুরতা থেকে পবিত্র হলে ক্বাযা আদায় করতে হবে।

বিঃ দ্রঃ বালিগ না হলেও ছোট ছেলে-মেয়ে যারা রোযা রাখতে পারবে তাদেরকে রোযা রাখিয়ে অভ্যাস করানো পিতা-মাতার দায়িত্ব-কর্তব্য।
যেসব কারণে রোযা ভঙ্গ হয় না:
নিম্নোক্ত কারণে রোযা ভঙ্গ হয় না-
১. ভুলক্রমে কোন কিছু পানাহার করলে। অতঃপর শেষ সময় পর্যন্ত পানাহার না করলে।
২. ভুলক্রমে নির্জনবাস করলে।
৩. রোযার মধ্যে দিনে ঘুমালে এবং ঘুমের মধ্যে গোসল ফরয হলে।
৪. আহলিয়ার প্রতি দৃষ্টিপাত করার কারণে মনি নির্গত হলে।
৫. তেল মালিশ করলে।
৬. শিঙ্গা লাগালে।
৭. চোখে সুরমা বা ওষুধ দিলে। উল্লেখ্য, ওষুধের স্বাদ গলায় অনুভূত হলে বা সুরমার রঙ থুথুর সাথে দেখা গেলেও রোযা ভঙ্গ হবে না।
৮. আহলিয়াকে বুছা দিলে।
৯. আপনা আপনি বমি করলে।
১০. রোযাদারের গলায় অনিচ্ছাকৃতভাবে ধোঁয়া গেলে।
১১. মুখে থুথু এলে বারবার না ফেলে গিলে ফেললে।
১২. রোযা অবস্থায় নখ ও চুল কাটলে।
১৩. রোযাদার ব্যক্তি স্বপ্নে কিছু খেলে বা পান করলে।
১৪. রাস্তায় চলাচলের সময় গাড়ির ধোঁয়া, রান্না করার সময় রান্নার ধোঁয়া নাকে প্রবেশ করলে মাজূর বা অক্ষমতার কারণে রোযা ভঙ্গ হবে না।
১৫. রোযা অবস্থায় সন্তানকে দুধ খাওয়ালে মায়ের রোযা ভঙ্গ হবে না। এমনকি ওযূও ভঙ্গ হবে না।

যেসব কারণে রোযা ভঙ্গ হয় এবং শুধু ক্বাযা ওয়াজিব হয়:
নিম্নলিখিত কারণসমূহে রোযা ভঙ্গ হয় এবং তার জন্য শুধু ক্বাযা আদায় করতে হবে, কাফফারা দিতে হবে না। সেগুলো হচ্ছে:
১. ইচ্ছাকৃত মুখ ভরে বমি করলে।
২. আহলিয়াকে বুছা বা স্পর্শ করার কারণে মনি নির্গত হলে।
৩. কোন অখাদ্য বস্তু তথা পাথর, লোহার টুকরো, ফলের আঁটি ইত্যাদি গিলে ফেললে।
৪. স্বাভাবিক স্থান ব্যতীত অন্যস্থানে মেলামেশায় মনি নির্গত হলে।
৫. জোরপূর্বক রোযাদারকে কিছু খাওয়ানো হলে।
৬. ভুলক্রমে কিছু খেতে আরম্ভ করে রোযা ভঙ্গ হয়েছে মনে করে পুনরায় আহার করলে।
৭. কুলি করার সময় পেটে পানি চলে গেলে।
৮. প্রস্রাব -পায়খানার রাস্তায় ওষুধ বা অন্য কিছু প্রবেশ করালে।
৯. রাত মনে করে ছুবহি ছাদিক্বের পর পানাহার করলে।
১০. সন্ধ্যা মনে করে সূর্যাস্তের পূর্বেই ইফতার করলে।
১১. মুখে বমি এনে পুনরায় তা পেটে প্রবেশ করালে।
১২. দাঁতের ফাঁক থেকে খাদ্য কণা বের করে খেয়ে ফেললে।
১৩. শরীরের কোন ক্ষতস্থানে ওষুধ লাগানোর ফলে তা ভেতরে প্রবেশ করলে।
১৪. রোযা অবস্থায় ইনজেকশন, ইনহেলার, স্যালাইন, ইনসুলিন ইত্যাদি ব্যবহার করলে।
১৫. নাকে বা কানে তেল বা তরল ওষুধ প্রবেশ করালে।
১৬. আগরবাতির ধোঁয়া নাকে প্রবেশ করলে।
১৭. রোযা রেখে পেস্ট, কয়লা, পাউডার, ছাই ইত্যাদি যে কোন প্রকার মাজন দ্বারা দাঁত মাজা মাকরূহ। এগুলোর সামান্য অংশও যদি গলায় প্রবেশ করে তাহলে রোযা ভঙ্গ হয়ে যাবে। এছাড়া সর্বাবস্থায় গুল ব্যবহার করা হারাম। কারণ গুল মাদকদ্রব্যের অন্তর্ভুক্ত।
১৮. রাত্রি বাকি আছে মনে করে ছুবহি ছাদিক্বের পর পানাহার করলে বা নির্জনবাস করলে রোযা ভঙ্গ হয়ে যাবে।

যেসব কারণে রোযা ভঙ্গ হয় এবং ক্বাযা ও কাফফারা উভয়ই ওয়াজিব হয়:
নিম্নলিখিত কাজসমূহ দ্বারা রোযা ভঙ্গ হয়ে যায় এবং ক্বাযা ও কাফফারা উভয়ই আদায় করা ওয়াজিব হয়। যথা:
১. ইচ্ছাকৃত নির্জনবাস করলে।
২. স্বেচ্ছায় পানাহার করলে।
৩. স্বেচ্ছায় ওষুধ পান করলে।
৪. শিঙ্গা লাগানোর পর রোযা নষ্ট হয়েছে মনে করে পানাহার করলে।
৫. ধূমপান করলে।

কাফফারা আদায় করার নিয়ম:
কাফফারা হচ্ছে দু’মাস ধারাবাহিক রোযা রাখা অথবা ষাটজন মিসকীনকে দু’বেলা তৃপ্তিসহকারে খাদ্য খাওয়ানো অথবা কোন গোলাম আযাদ করা।
সন্তানসম্ভবা ও দুগ্ধদায়িনীর রোযা রাখার হুকুম:
গর্ভবতী ও দুগ্ধদানকারিণী যদি আশঙ্কাবোধ করে যে, রোযা রাখলে যথাক্রমে তাদের গর্ভস্থ ভ্রুণ ও দুগ্ধপানকারী সন্তান ক্ষতিগ্রস্ত হবে তাহলে তাদের জন্য রোযা না রাখা জায়িয হবে। পরে এর ক্বাযা আদায় করে নিবে। কাফফারা বা ফিদিয়া প্রদান করতে হবে না।
বয়ো-বৃদ্ধের রোযার হুকুম:
অতিশয় বৃদ্ধ যে রোযা রাখতে অক্ষম তার জন্য অনুমতি রয়েছে যে, সে রোযা ভঙ্গ করতে পারবে এবং প্রতিদিনের রোযার পরিবর্তে একজন মিসকীনকে তৃপ্তি সহকারে দু’বেলা খাওয়াবে। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ পাক রব্বুল আলামীন তিনি ইরশাদ ফরমান:
وعلى الذين يطيقونه فدية طعام مسكين
অর্থ: “যাদের রোযা রাখতে অতিশয় কষ্ট হয় তাদের কর্তব্য হলো এর পরিবর্তে ফিদিয়া তথা একজন অভাবগ্রস্তকে (মিসকীন) খাদ্য দান করা।” (সূরা বাক্বারা শরীফ)

 রোযার নিয়ত ও ইফতারের দুআ এবং সুন্নত আমলসমূহ:-

সাহরীর পরিচয়:
রমাদ্বান শরীফ মাসে শেষ রাতের খাবারকে সাহরী বলে। অর্থাৎ ছুবহি ছাদিক্বের পূর্বে রোযা রাখার নিয়তে পানাহার করাকে সাহরী বলে। সাহরী করা খাছ সুন্নতে রসূল ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম। হাদীছ শরীফ-এ ইরশাদ হয়েছে, তোমরা সাহরী খাও, কেননা সাহরী খাওয়ার মধ্যে বরকত রয়েছে। (বুখারী শরীফ, মুসলিম শরীফ)
রোযার নিয়ত:
نويت ان اصوم غدا من شهر رمضان المبارك فرضا لك ياالله فتقبل منى انك انت السميع العليم.
উচ্চারণ: নাওয়াইতু আন আছুমা গদাম মিং শাহরি রমাদ্বানাল মুবারকি ফারদ্বল্লাকা ইয়া আল্লাহু ফাতাক্বব্বাল মিন্নী ইন্নাকা আংতাস সামীউল আলীম।
অর্থ: আয় আল্লাহ পাক! আপনার সন্তুষ্টির জন্য আগামীকালের রমাদ্বান শরীফ-এর ফরয রোযা রাখার নিয়ত করছি। আমার তরফ থেকে আপনি তা কবুল করুন। নিশ্চয়ই আপনি সর্বশ্রোতা , সর্বজ্ঞাত।

মাসআলা: কেউ যদি ছুবহি ছাদিক্বের পূর্বে নিয়ত করতে ভুলে যায় তাহলে তাকে দ্বিপ্রহরের পূর্বে নিয়ত করতে হবে। তখন এভাবে নিয়ত করবে:
نويت ان اصوم اليوم من شهر رمضان المبارك فرضا لك يالله فتقبل منى انك انت السميع العليم.

উচ্চারণ: নাওয়াইতু আন আছুমাল ইয়াওমা মিন শাহরি রমাদ্বানাল মুবারকি ফারদ্বাল্লাকা ইয়া আল্লাহু ফা তাক্বাব্বাল মিন্নী ইন্নাকা আংতাস সামীউল আলীম।
সাহরীর সুন্নত আমল: জরুরত আন্দাজ খাওয়া-দাওয়া করার পর বেজোড় সংখ্যক খুরমা-খেজুর খাওয়া খাছ সুন্নত। রাতের শেষভাগে সাহরী করা সুন্নতের অন্তর্ভুক্ত।

ইফতার-এর পরিচয়:
ইফতার অর্থ ভঙ্গ করা। সন্ধ্যা রাতে তথা মাগরিবের আযানের পর খুরমা-খেজুর, দুধ, শরবত ইত্যাদি দ্বারা পানাহারের মাধ্যমে রোযা ভঙ্গ করাকে ইফতার বলে।
ইফতার-এর দুআ:
اللهم لك صمت و على رزقك افطرت.
উচ্চারণ: আল্লাহুম্মা লাকা ছুমতু ওয়া আলা রিযক্বিকা আফত্বরতু।
অর্থ: আয় আল্লাহ পাক! আমি আপনারই সন্তুষ্টির জন্য রোযা রেখেছি এবং আপনারই দেয়া রিযিক্ব দ্বারা ইফতার করছি।

ইফতার-এর সুন্নত আমল:
*খুরমা-খেজুর দ্বারা ইফতার শুরু করা খাছ সুন্নত।
*ওয়াক্ত হওয়ার সাথে সাথে ইফতার করা খাছ সুন্নত। হাদীছে কুদসী শরীফ-এ রয়েছে, আল্লাহ পাক তিনি বলেন: “আমার বান্দাদের মধ্যে আমার নিকট অধিকতর প্রিয় ওই ব্যক্তিরাই যারা তাড়াতাড়ি ইফতার করে অর্থাৎ সময় হওয়ার সাথে সাথে ইফতার করে।” কিন্তু সময় হয়নি এ অবস্থায় তাড়াতাড়ি করে পানাহার করলে ক্বাযা-কাফফারা উভয়ই ওয়াজিব হবে।
*ইফতার করার পূর্বে তিনবার দুরূদ শরীফ পাঠ করা।
*কোন রোযাদারকে ইফতার করানো। এটা অত্যধিক ফযীলতের কারণ।
বিঃ দ্রঃ সাহ্রী ও ইফতার-এর সময়ের ব্যাপারে সচেতন থাকতে হবে যেন সময় কম-বেশি না হয়। সেজন্য সাবধানতার নিমিত্তে সাহ্রী-এর সময় থেকে ৫ মিনিট কমিয়ে ও ইফতারী-এর সময় থেকে ৫ মিনিট বাড়িয়ে সাহরী ও ইফতার করা উচিত।
আর ইফতার ও সাহরীর ঘোষণার জন্য সাইরেন বাজানো হারাম। এক্ষেত্রে ইফতারীর জন্য আযান দেয়া আর সাহরীর জন্য মুখে বা মাইকে ঘোষণা দেয়াই সর্বোত্তম ও একমাত্র মাধ্যম।

ছলাতুত তারাবীহ-এর হুকুম ও আহকাম:

ছলাতুত তারাবীহ বা তারবীহ নামায: তারাবীহ শব্দটি বহুবচন। একবচনে ‘তারবীহাতুন’। এর অর্থ হচ্ছে বিশ্রাম নেয়া বা আরাম করা। পাঁচ তারবীহাতুন মিলে এক তারাবীহ। অর্থাৎ, চার রাকাআত পর পর বসে দুআ, দুরূদ ও তাসবীহ পাঠের মাধ্যমে বিশ্রাম নিয়ে বিশ রাকাআত নামায আদায় করা হয় বলে এর নামকরণ করা হয়েছে ‘তারাবীহ’।
মাসআলা: তারাবীহ্ নামায বিশ রাকাআত।
পুরুষ-মহিলা প্রত্যেকের জন্যই এ নামায সুন্নতে মুয়াক্কাদাহ। বিশ রাকাআত থেকে কেউ যদি এক রাকাআতও কম পড়ে তাহলে সুন্নতে মুয়াক্কাদাহ তরক করার কারণে ওয়াজিব তরকের গুনাহে গুনাহগার হবে।
তারাবীহ নামায জামাআতে পড়া, তা খতম তারাবীহ হোক বা সূরা তারাবীহ হোক উভয়টিই পৃথকভাবে সুন্নতে মুয়াক্কাদাহ কিফায়া। খতমে তারাবীহ পড়িয়ে বা কুরআন শরীফ খতম করে উজরত বা পারিশ্রমিক গ্রহণ করা জায়িয। মহিলাদের মসজিদে গিয়ে জামাআত-এর সাথে তারাবীহ বা অন্যান্য নামায আদায় করা সম্পূর্ণরূপে হারাম ও কুফরী।

তারাবীহ নামায বিশ রাকাআত পড়ার দলীল:
আহ্লে সুন্নত ওয়াল জামাআতের ফতওয়া মুতাবিক তারাবীহ-এর নামায বিশ রাকাআত পড়াই সুন্নতে মুয়াক্কাদাহ। অতএব, কেউ যদি বিশ রাকাআত থেকে এক রাকাআতও কম পড়ে, তবে তার সুন্নতে মুয়াক্কাদাহ তরক করার গুনাহ হবে। অর্থাৎ তারাবীহ-এর নামায বিশ রাকাআতই পড়তে হবে। এর উপরই ইজমা হয়েছে। যারা তারাবীহ-এর নামায ৮ রাকাআত বলে থাকে, তারা বুখারী শরীফ-এ বর্ণিত উম্মুল মু’মিনীন হযরত আয়িশা ছিদ্দীক্বা আলাইহাস সালাম উনার হাদীছ শরীফখানা দলীলস্বরূপ পেশ করে থাকে। যাতে বর্ণিত আছে যে, “আল্লাহ পাক উনার রসূল হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম রমাদ্বান শরীফ-এ এবং রমাদ্বান শরীফ ব্যতীত অন্যান্য মাসে (বিতর সহ) ১১ রাকাআত নামায আদায় করতেন।” মূলত এটি হচ্ছে তাহাজ্জুদ নামাযের বর্ণনা, তারাবীহ-এর নামাযের বর্ণনা নয়। কারণ তারাবীহ নামায শুধুমাত্র রমাদ্বান শরীফ-এর জন্যই নির্দিষ্ট। রমাদ্বান শরীফ ব্যতীত অন্যান্য মাসে তারাবীহ নামায নেই। আর তাহাজ্জুদের নামায সারা বছরই পড়তে হয়।
অতএব, হানাফী মাযহাব মতে “তারাবীহ-এর নামায বিশ রাকাআত”- এ ব্যাপারে বহু হাদীছ শরীফ বর্ণিত রয়েছে।
যেমন এ প্রসঙ্গে হাদীছ শরীফ-এ বর্ণিত রয়েছে-
عن ابن عباس رضى الله تعالى عنه ان النبى صلى الله عليه وسلم كان يصلى فى رمضان عشرين ركعة سوى الوتر.

অর্থ: “হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু বর্ণনা করেন, নিশ্চয়ই আল্লাহ পাক উনার হাবীব ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বিশ রাকাআত তারাবীহ নামায পড়তেন বিতর নামায ব্যতীত।” অর্থাৎ তারাবীহ নামায বিশ রাকাআত এবং বিতর তিন রাকাআত মোট তেইশ রাকাআত। (মুছান্নাফ ইবনে আবী শায়বা)
হাদীছ শরীফ-এ আরো বর্ণিত রয়েছে-
عن على وعمر رضى الله تعالى عنهما وغيرهما من اصحاب النبى صلى الله عليه وسلم عشرين ركعة.

অর্থ: “হযরত আলী রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু ও হযরত উমর ইবনূল খত্তাব রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু এবং অন্যান্য ছাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুম উনাদের থেকে বর্ণিত রয়েছে, তারাবীহ নামায বিশ রাকাআত।” (তিরমিযী শরীফ)
روى البيهقى باسناد صحيح كانوا يقيمون على عهد عمر عشرين ركعة على عهد عثمان وعلى رضى الله تعالى عنهم.

অর্থ: হযরত ইমাম বায়হাক্বী রহমতুল্লাহি আলাইহি ছহীহ সনদে বর্ণনা করেন যে, “খুলাফায়ে রাশিদীন হযরত উমর ফারূক্ব রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু, হযরত উছমান যুন নূরাইন রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু, হযরত আলী কাররামাল্লাহু ওয়াজহাহু রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু উনারা সকলেই বিশ রাকাআত (তারাবীহ) নামায আদায় করেছেন।”
عن يزيد بن رومان رحمة الله عليه انه قال كان الناس يقومون فى زمان عمربن الخطاب رضى الله تعالى عنه فى رمضان بثلث وعشرين ركعة.

অর্থ: “হযরত ইয়াযীদ ইবনে রুমান রহমতুল্লাহি আলাইহি বর্ণনা করেন, হযরত উমর ফারূক্ব রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু উনার খিলাফতকালে সকল ছাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুম উনারা সকলেই তারাবীহ নামায ও বিতর নামাযসহ মোট তেইশ রাকাআত নামায আদায় করতেন।” (মুওয়াত্তা ইমাম মালিক)
এ সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে হলে, যামানার তাজদীদী মুখপত্র “মাসিক আল বাইয়্যিনাত শরীফ”-এর ২৫, ২৬, ২৭, ২৮, ২৯, ৩০, ১৭৫তম সংখ্যা পাঠ করুন। সেখানে ৩০৪ খানা অকাট্য ও নির্ভরযোগ্য দলীলের ভিত্তিতে ছাবিত করা হয়েছে যে, তারাবীহ নামায বিশ রাকাআত পড়াই সুন্নতে মুয়াক্কাদাহ এবং এটাই গ্রহণযোগ্য ও ছহীহ মত।
ছলাতুত তারাবীহ-এর নিয়ত

نويت ان اصلى لله تعالى ركعتى صلوة التراويح سنة رسول الله تعالى متوجها الى جهة الكعبة الشريفة الله اكبر.
উচ্চারণ: নাওয়াইতু আন উছল্লিয়া লিল্লাহি তা’আলা রকাআতাই ছলাতিত তারাবীহ সুন্নাতু রসূলিল্লাহি তা’আলা মুতাওয়াজ্জিহান ইলা জিহাতিল কা’বাতিশ শারীফাতি আল্লাহু আকবার।

অর্থ: আমি ক্বিবলামুখী হয়ে দু’রাকাআত তারাবীহ সুন্নতে মুয়াক্কাদাহ নামাযের নিয়ত করছি। আল্লাহু আকবার।
 তারাবীহ নামায-এ দু’রাকাআত পর পর দুআ:
তারাবীহ নামায-এর দু’রাকাআত পর নিম্নোক্ত দুআ পড়তে হয়-
هذا من فصل ربى يا كريم المعروف يا قديم الاحسان احسن الينا باحسانك القديم ثبت قلوبنا على دينك برحمتك يا ارحم الرحمين.
উচ্চারণ: হা-যা মিং ফাদ্বলি রব্বী ইয়া কারীমাল মা’রূফ, ইয়া ক্বদীমাল ইহসান, আহসিন ইলাইনা বি ইহসানিকাল ক্বদীম। ছাব্বিত ক্বুলূবানা আলা দীনিকা বিরহমাতিকা ইয়া আরহামার রহিমীন।

তারাবীহ নামায-এ চার রাকাআত পর পর দুআ:
তারাবীহ নামায-এ চার রাকাআত পর পর নিম্নোক্ত দুআ পড়তে হয়-
سبحان ذى الملك والملكوت سبحان ذى العزة والعظمة والهيبة والقدرة والكبرياء والجبروت . سبحان الملك الحى الذى لاينام ولا يموت ابدا ابدا سبوح قدوس ربنا ورب الملئكة والروح.

উচ্চারণ: সুব্হানাযিল মুলকি ওয়াল মালাকূতি সুবহানাযিল ইযযাতি ওয়াল আযমাতি ওয়াল হাইবাতি ওয়াল ক্বুদরতি ওয়াল কিবরিয়ায়ি ওয়াল জাবারূত। সুব্হানাল মালিকিল হায়্যিল্লাযী লা-ইয়ানামু ওয়ালা ইয়ামূতু আবাদান আবাদা। সুব্বূহুন ক্বুদ্দূছুন রব্বুনা ওয়া রব্বুল মালা-য়িকাতি ওয়ার রূহ্।
তারাবীহ নামায-এ চার রাকাআত পর পর মুনাজাত
اللهم صل على سيدنا ونبينا وحبيبنا وشفيعنا ومولنا صلى الله عليه وسلم. رب ارحم هما كما ربيانى صغيرا. ربنا افرغ علينا صبرا وتوفنا مسلمين. ربنا اتنا فى الدنيا حسنة وفى الاخرة حسنة وقنا عذاب النار. اللهم انا نسئلك الجنة ونعوذبك من النار يا خالق الجنة والنار. برحمتك ياعزيز ياغفار ياكريم ياستار يارحيم يا جبار يا خالق يا بار. اللهم اجرنا من النار يا مجير يا مجير يا مجير برحمتك يا ارحم الراحمين. سبحان ربك رب العزة عما يصفون. وسلام على المرسلين. والحمد لله رب العلمين.

মুনাজাত: আল্লাহুম্মা ছল্লি আ’লা সাইয়্যিদিনা ওয়া নাবিয়্যিনা ওয়া হাবীবিনা ওয়া শাফী’য়িনা ওয়া মাওলানা ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম। রর্ব্বিহাম হুমা কামা রব্বাইয়্যানী ছগীরা, রব্বানা আফ্রিগ্ আলাইনা ছব্রাওঁ ওয়া তাওয়াফ্ফানা মুসলিমীন। আল্লাহুম্মা ইন্না নাসআলুকাল জান্নাতা ওয়া না’ঊযুবিকা মিনান নার। ইয়া খালিক্বাল জান্নাতি ওয়ান নার। বিরহমাতিকা ইয়া আযীযু ইয়া গফ্ফারু ইয়া কারীমু ইয়া সাত্তারু ইয়া রহীমু ইয়া জাব্বারু ইয়া খালিক্বু ইয়া বা-র। আল্লাহুম্মা আজিরনা মিনান নার। ইয়া মুজীরু ইয়া মুজীরু ইয়া মুজীর। বিরহমাতিকা ইয়া আরহামার রহিমীন। সুবহানা রব্বিকা রব্বিল ইয্যাতি আম্মা ইয়াছিফূন-ওয়া সালামুন আলাল মুরসালীন। ওয়াল-হামদুলিল্লাহি রব্বিল আলামীন।

No comments:

Post a Comment