Saturday, November 22, 2014

কাজী নজরুল ইসলামের হিন্দু মহিলা বিবাহ এবং করুণ পরিণতি ।। বাঙালি মুসলমানদের জন্য শিক্ষণীয়!!

আল্লাহওয়ালা হওয়ার শিক্ষা, কাফির-মুশরিকদের শত্রুজ্ঞান করার শিক্ষা ও সর্বোপরি মুর্শিদ ক্বিবলা আলাইহিস সালাম উনার প্রতি বিমুখতা তথা অভিভাবকহীনতার কারণেই নজরুলের ন্যায় মুসলিম প্রতিভাগুলো নানাভাবে কেড়ে নিচ্ছে বিধর্মী ইহুদি-খ্রিস্টান-হিন্দু সম্প্রদায়।
 বাঙালি মুসলমানগণ উনাদের ইতিহাসে এক অবিস্মরণীয় নক্ষত্রের নাম কাজী নজরুল ইসলাম। ব্রিটিশআমলে যখন বাঙালি মুসলিম সমাজ চরম হতাশায় নিমজ্জিত, তখন বাংলা ভাষায় হামদ-নাত ও ইসলামী ভাবধারাম-িত কবিতা লেখার সূত্রপাত করে তিনি বাংলার মুসলমান সমাজে নবজীবন দান করেন।
তবে কাজী নজরুল ইসলাম থেকে বাঙালি মুসলমান যা পেয়েছে, তা নজরুল-প্রতিভার বিচারে সিন্ধুর মাঝে বিন্দুও নয়। কারণ কাজী নজরুল ইসলাম বসবাস করতেন হিন্দুদের সমাজে এবং হিন্দু সমাজ, পরিবার এমনকি নিজগৃহে বসবাসকারী হিন্দু শাশুড়ির কটাক্ষ হজম করে তিনি তার অন্যান্য রচনার মাঝে মাঝে হামদ-নাত রচনা করতেন। অর্থাৎ তিনি যদি হিন্দু সমাজে নিজেকে না সঁপে দিয়ে মুসলিম সমাজে থাকতেন, তাহলে তিনি তার পূর্ণ উদ্যমকে ইসলামী সাহিত্য উনার জন্য উৎসর্গ করতে পারতেন এবং সেক্ষেত্রে বাঙালি মুসলিম সাহিত্যের ইতিহাস নতুনভাবে লেখা হতে পারতো।

কাজী নজরুল ইসলাম যখন অসুস্থ হয়ে পড়েন, তখন তার খিদমত করেছিলেন সূফী জুলফিকার হায়দার। তার রচিত নজরুল জীবনের শেষ অধ্যায় নজরুল গবেষকদের নিকট একটি অবশ্যপাঠ্য বই।
ফররুখ আহমদ ও গোলাম মোস্তফাদের ন্যায় সূফী জুলফিকার হায়দারও পাকিস্তান আমলের বাংলা সাহিত্যের অন্যতম প্রধান কবি, কিন্তু বর্তমান প্রজন্ম তার সম্পর্কে কিছুই জানে না। কারণ তিনি নিজে ছিলেন পীর সাহেবের হাতে বাইয়াত এবং সূফী, যার ফলে তাঁর কবিতাও ছিল ইসলামী ভাবধারামন্ডিত। ফলে আমরা বর্তমানে যেই স্বাধীন (!) বাংলাদেশ পেয়েছি, তাতে তাঁর অবদান মুছে ফেলা হয়েছে। শুধু তাই নয়, এদেশে কর্তৃক পরাধীন প্রকাশনা শিল্পের কারণে নজরুলকে নিয়ে লেখা তাঁর মূল্যবান বইটিও ছাপার অভাবে হয়ে পড়েছে দুষ্প্রাপ্য। বইটি থেকে কিছু উদ্ধৃতি তুলে ধরা হলো, যা বর্তমান প্রজন্মের পাঠকদের জানাটা খুবই দরকার-
আমার মনে হয়, নজরুলের বিবাহ সংক্রান্ত ব্যাপারটি তাঁর জীবনের একটি বড় অভিশাপ। বিদ্রোহীর কবি কিন্তু তাঁর ব্যক্তিগত বা পারিবারিক জীবনে সাধারণতঃ বিদ্রোহী ছিলেন না এবং তা ছিলেন না বলেই তিনি তাঁর জীবনে হিন্দু কিংবা মুসলমান কোনো ধর্মেরই আচার অনুষ্ঠান পালন করে চলেননি। বাড়িতে তিনি ভগবানএবং জলবলতেন, আবার মুসলমানদের সামনে আল্লাহএবং পানিবলতেন। কিন্তু তাঁর স্ত্রী ও শাশুড়ি একেবারে নির্ভেজাল হিন্দু আগেও ছিল এবং বরাবর আমি তাই দেখেছি। এই যে গোঁজামিল-কবির মানসিক জীবনে এর চেয়েও বড় দুর্বলতা আর কিছু হতে পারে বলে আমি বিশ্বাস করি না। এই পরিবেশেই তিনি একদিকে যেমন লিখেছেন শ্যামাসঙ্গীত, অপরদিকে তেমনি হৃদয় উজাড় করে রচনা করেছেন ইসলামী হামদ্, না, গজল আর কবিতা। এ ব্যাপারে আমি যতটুকু জানি, ইসলামী ভাবধারায় উদ্বুদ্ধ লেখার জন্য তাঁকে প্রতিকুলতা সহ্য করতে হয়েছে যথেষ্ট। এমনকি তার শ্বশুরকুলের অনেকের কাছ থেকে- বিশেষ করে শাশুড়ীর কাছ থেকে নির্মম বাক্যবাণ ও উপহাস সহ্য করতে হয়েছে। ...
এখানে দুই একটি ঘটনার উল্লেখ করছি। যে দিনের কথা বলছি তখন তিনি বাংলা সাহিত্যে সুপ্রতিষ্ঠিত এবং দেশবাসী, বন্ধু-বান্ধব ও আত্মীয়-স্বজনের কাছ থেকে বিশেষভাবে স্বীকৃতি পেয়েছেন।
নজরুলের দুটি ছেলে-সানি আর নিনী (কাজী সব্যসাচী ও কাজী অনিরুদ্ধ) মুসলমানী বিধান অনুযায়ী আমি ওদের খতনা করাবার জন্য বিশেষভাবে চেষ্টা করেছিলাম।  কিন্তু কবিকে রাজী করাতে পারিনি। তার কারণ অবশ্য সুস্পষ্ট। তাঁর শ্বাশুড়ী ও স্ত্রীর কাছে এই প্রস্তাব উত্থাপন করার শক্তিও নজরুলের ছিল না। আমি তখন তাঁকে বলেছিলাম, কাজীদা, আমিই ভাবী ও মাসীমাকে এ সম্পর্কে বলে দেখি।
এ প্রস্তাবে তিনি আমার প্রতি চটে গিয়েছিলেন। আমার প্রস্তাব কার্যকরী করা তাঁর পক্ষে সম্ভবপর ছিল না বলেই মনে হয় তিনি বিরক্তিবোধ করেছিলেন।
১৯৪০ সালের ঈদুল আযহাউনার দিবসে কবি সানি ও নিনীকে সাথে নিয়ে আমার তদানীন্তন বাসভবন কলকাতার পার্ক সার্কাসে এসেছিলেন। তখন ওদের বয়স যথাক্রমে প্রায় দশ ও আট হবে। কিন্তু ওরা খাবার টেবিলে মুসলমানী কায়দায় খেতে অসুবিধা বোধ করছিল- লক্ষ্য করলাম। তাছাড়া, আমি আরও লক্ষ্য করেছি- আমার সাথে ওরা যে কয়েকবার শ্যামবাজার থেকে আমার ৮৪নং ঝাউতলা রোডের বাসভবনে এসেছে কিংবা ওয়াছেল মোল্লা বা কমলালয়ের দোকানে গিয়েছে, ততবারই কর্নওয়ালিস স্ট্রীটের ট্রামে ঠনঠনিয়া কালিবাড়ী অতিক্রম করার সময়ে আর পাঁচজন হিন্দুর মতোই এই ছেলে দুটিও চলন্ত ট্রাম থেকে দেবী কালীর উদ্দেশ্যে যুক্ত করে প্রণাম নিবেদন করেছে।
আমি ওরকম করতে তাদের বারণ করেছি। ওরা শুধু ছেলে মানুষের মতোই হেসেছে, কোনোই জবাব দেয়নি।
নজরুল ইসলামের ছেলেদের এই যে শিক্ষা আর তাঁর জীবনে এই যে গোঁজামিল, সেজন্য আমি বরাবর পীড়াবোধ করেছি।
নজরুলের বাড়িতে আমি ঘণ্টার পর ঘণ্টা অবস্থান করেছি। বাড়ির আবহাওয়া ও আচার ব্যবহার সব কিছুতে অতিমাত্রায় হিন্দুয়ানী লক্ষ্য করেছি। এমনও হয়েছে- আছর ও মাগরিব নামায আমাকে সেখানেই পড়তে হয়েছে। নামাযের জায়নামায বা অন্য কোনো ব্যবস্থাই সেখানে ছিল না। আলমারী থেকে টেনে এনে ধোয়া বড় তোয়ালে বিছিয়ে নামাযে দাঁড়িয়ে গেছি; এমনি সময়ে কবি-পত্নীর দিদিমার (নানী) সন্ধ্যা আহ্নিকের কাঁসার-ঘণ্টা তিন তলার ছাদের চিলেকোঠায় বেঁজে উঠেছে। কবি-পত্নীর দিদিমা ছিল গোঁড়া হিন্দু মহিলা। এই গোঁড়া হিন্দু বৃদ্ধা পূজা-আহ্নিক নিয়ে সারাটি দিনই মেতে থাকতো।
এ সব ঘটনা পরম্পরা কবির মনে কোনো জিজ্ঞাসা বা প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছে কিনা, তা তিনি মুখ ফুটে কোনো দিনই বলেননি। আমার মনে হয়, তিনি নিতান্ত নিঃসহায় নিরীহের মতোই পারিবারিক জীবনে লাগাম ছেড়ে দিয়ে- যার যেমন খুশি, তেমনি চলো- এই নীতি অবলম্বন করেছিলেন।
এ ব্যাপারে বাধা তো এটুকুই ছিলো যে, নিজের নামটা শুধু বদলে দিয়ে হিন্দু হয়ে গেলেই হতো। অথবা তাঁর স্ত্রীকে মুসলিম স্বামীর মুসলিম স্ত্রী বানিয়ে নিতে পারতেন।
কিন্তু এ সবের কিছুই তিনি করলেন না। আমাদের মধ্যে এমনও কয়েকজন বিদগ্ধ সম্ভ্রান্ত পন্ডিত ও রাজনীতিবিদ রয়েছেন, যারা হিন্দু মেয়ে বিবাহ করেছেন। কিন্তু তাদের বেলায় এহেন দুর্বলতা প্রকাশ পেয়েছে কিনা জানি না। এ কি ভাগ্যের অদ্ভূত পরিহাস! আঁধার রাতে বাধার পথে রক্ত করি পথ পিছল- এহের ক্ষুরধার বাণী যে কবির, তাঁর জীবনে গোঁজামিল কি করে সম্ভব হলো?
১৯৪০ সালের কথা। এ সময় একদিন নজরুল ইসলাম আমার বাড়িতে এসে স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে এক ওয়াক্ত নামায পড়ে ছিলেন। কিন্তু তাঁর বিবাহিত জীবনে আপন স্ত্রী, শাশুড়ী প্রভৃতি পরিবারের লোকদের সামনে কোনো সময় তিনি মহান আল্লাহ পাক ও হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার নাম মুবারক উচ্চারণ করেছেন-  এমন কথা বলতে পারার মতো আমি জানি, এমন কেউ নেই। কিন্তু ছেলেবেলা থেকে পল্টন জীবনের পূর্ব পর্যন্ত তাঁর পারিবারিক পরিবেশ ও ঐতিহ্যের তাগিদে তিনি যথাক্রমে মসজিদের খাদেম, মুয়াজ্জিন ও মোল্লার কাজ করেছেন এবং রীতিমতো নামায পড়েছেন।
আজ আমার কেবলি মনে হচ্ছে, নজরুল যদি তাঁর আপন ধর্মীয় বিশ্বাস ও ঐতিহ্য অনুযায়ী পরিবেশ পেতেন, তবে হয়তো আজ তাঁর জীবনে এরূপ মর্মন্তুদ পরিণতি দেখবার দুর্ভাগ্য আমাদের হতো না।
কবি জুলফিকার হায়দার সাহেব তার লেখায় বারবার কেবল একটি আফসোসই করেছেন, যদি কাজী নজরুল ইসলাম তার মুসলিম স্ত্রীকে ত্যাগ না করে হিন্দু স্ত্রী গ্রহণ না করতেন, তাহলে নজরুলকে তার আদর্শ ও ধর্মের সাথে সাংঘার্ষিক পরিবেশে বসবাস করতে হতো না। তাকে মস্তিষ্ক বিকৃতির কবলে পড়তে হতো না, কাজী নজরুলের এমন মর্মন্তুদ পরিণতি আমাদের দেখতে হতো না।
কিন্তু এজন্য নজরুলই কি কেবল দায়ী? কারণ নজরুল যেভাবে মুসলমান হিসেবে তার শত্রু চিনতে পারেনি, ঠিক সেভাবেই নজরুলের প্রথম স্ত্রী নার্গিসের বাড়ির লোকজনও মুসলমান হিসেবে তাদের শত্রু চিনতে পারেনি। নজরুলের প্রথম বিয়ে হয়েছিল সাইয়্যিদা নার্গিস আসার খানমের সাথে। সাইয়্যিদা নার্গিস আসার খানমের মামা আলী আকবর খান ছিলেন নজরুলের অন্তরঙ্গ বন্ধু।
আলী আকবর খান তিনি নজরুলের সাথে তার ভাগ্নীর বিয়েতে দাওয়াত দিয়েছিলেন বীরেন্দ্রনাথ সেন নামক তার এক হিন্দু বন্ধুকে। আলী আকবরের এই হিন্দু বন্ধুও তার মা বিরজাসুন্দরী দাওয়াত পেয়ে, বিয়ের আসরে উপস্থিত হয়ে বিয়ে ভাঙার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়। বিয়ের পরও তারা নানারকম উস্কানী দিয়ে নজরুলের মনকে বিষিয়ে তোলে। তারপর বাসর রাতে কুচক্রী বীরেন্দ্র  সে নজরুলকে নিজের সাথে ভাগিয়ে নিয়ে যায় তাদের নিজেদের বাড়িতে। সেখানে লম্বা সফরে অসুস্থ নজরুলের সেবায় নিয়োজিত হয় বীরেন্দ্রর ভাগ্নী আশালতা ওরফে প্রমীলা। এই প্রমীলাই পরবর্তীতে নজরুলের হিন্দু স্ত্রী হয়েছিল।

সুতরাং দোষ নজরুলের একার নয়, দোষ গোটা মুসলমান সমাজেরই। তারা কখনোই তাদের শত্রু চিনতে পারেনি, যে কারণে তারা যুগে যুগে হারিয়েছে তাদের রাজত্ব, তাদের সম্পদ, এমনকি নজরুলের মতো প্রতিভাও! নজরুলকে মুসলিম স্ত্রীর কাছ থেকে ছিনিয়ে নিয়ে হিন্দু মেয়ের সাথে বিয়ে দেয়ার ঘটনাটিকে শুধু একটি হিন্দু পরিবারের চক্রান্ত হিসেবে দেখলে হবে না, বরং এ ছিল হিন্দুদের জাতিগত চক্রান্ত। তারা চেয়েছিল, যেন নজরুলের প্রতিভা কোনো অবস্থাতেই মুসলমানদের উপকারে না আসে। এ কারণেই হিন্দুরা মুসলিম স্ত্রীর সাথে নজরুলের ঘর ভেঙে, তাকে হিন্দু মেয়ের হাতে গছিয়ে দিয়ে তাকে হিন্দু বলয়ে নিয়ে এসেছিল।

No comments:

Post a Comment