এ বছর (অর্থাৎ ১৪৩৬ হিজরী) সরকার এক নতুন আইন করেছে; বলছে- সরকার কর্তৃক নির্ধারিত
স্থানে কুরবানী দিতে হবে। ঢাকা শহরে ৪৯৩টি এবং চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন ২০টি স্পট
নির্ধারণ করে সিটি কর্পোরেশন বলেছে, ওই সব স্পটে কুরবানী না দিলে তারা কুরবানীদাতাদের বিরুদ্ধে আইনানুনগ
ব্যবস্থা নিবে। নাউযুবিল্লাহ!
অথচ সরকার কিংবা সিটি কর্পোরেশন কি একবার ভেবে দেখেছে, আদৌ এ ধরনের সিদ্ধান্তের মাধ্যমে
মুসলমানদের ধর্মীয় অধিকার সংরক্ষিত হবে কিনা? কিংবা এ ধরনের একটি সিস্টেম বাস্তবেই
সম্ভব কিনা? কিংবা সরকার নিজেই এর ধকল সামলাতে পারবে কিনা?
আমার মনে হয়- সরকারের যে মহল এ ধরনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে, তারা কখনোই কুরবানীর মতো বিষয়
সম্পর্কে ফিল্ড পর্যায়ে ওয়াকিবহাল নয় এবং পুরোপুরি চিন্তাও করেনি।
নতুন সিস্টেমে কতটুকু ধর্মীয় অধিকার সংরক্ষিত থাকবে?
পবিত্র কুরবানী মুসলমান উনাদের ওয়াজিব আমল। এ আমল নিজ হস্তে করা সুন্নত। কিন্তু
এ সিস্টেমে কুরবানীদাতা নিজ হাতে কুরবানী করতে পারবেন না, সরকার যাকে ঠিক করে দিবে তার
মাধ্যমে কুরবানী করতে হবে। শুরুতেই দেখা যাচ্ছে- একটি সুন্নত থেকে মাহরূম হতে হলো।
এরপর শরীয়ত অনুযায়ী যে ব্যক্তি জবাই করবে তার আক্বীদাও শুদ্ধ হতে হবে, বদ আক্বীদাযুক্ত হলে কুরবানী
শুদ্ধ হবে না।
তাই স্বাভাবিক প্রশ্ন উঠে, সরকার কি সেই নিশ্চয়তা দিতে পারবে জবাইদাতার আক্বীদা ১০০ ভাগ শুদ্ধ? বলাবাহুল্য, আক্বীদা কি জিনিস সেটা সরকার
নিজেই জানে না; শুদ্ধ, নাকি অশুদ্ধ তা নির্ণয় তো বহু পরের বিষয়। আবার কুরবানী ঈদের দিন কুরবানীকৃত পশুর
গোশত দিয়ে প্রথম আহার করা সুন্নত। সরকার কি মুসলমানদের সেই সুন্নত পালনের নিশ্চয়তা
দিতে পারবে? প্রকৃতপক্ষে সেই সুন্নত পালনও সম্ভব হবে না।
এ ধরনের একটি সিস্টেম কি আদৌ সম্ভব?
ক) ঢাকা শহরে কুরবানী হয় প্রায় ৩০ লক্ষাধিক। এই ৩০ লক্ষ কুরবানী করার জন্য সরকার
স্পট দিয়েছে মাত্র ৫শটির মতো। অর্থাৎ প্রতি স্পটে কুরবানী করতে হবে গড়ে ৬ হাজারটি।
খ) সরকার প্রথম থেকেই ঘোষণা দিচ্ছে, প্রত্যেক স্পটে সরকার কর্তৃক নির্ধারিত কসাই থাকবে, তাদের দিয়ে গোশত কাটা সারতে হবে।
ধরে নিলাম প্রতি স্পটে ২০০ করে চৌকশ কসাই টিম দিতে পারবে সরকার। তাহলে ৫০০ স্পটে চৌকশ
কসাই টিম লাগবে ১ লক্ষটি। এতগুলো চৌকশ কসাই টিম কি সরকারের আছে?
গ) ধরে নিলাম, একটি চৌকশ কসাই টিমের জন্য একটি গরু শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত প্রসেসিং করতে কম করে
সময় লাগবে ৩ ঘণ্টা। তাহলে ঈদের দিন সকাল ৯ থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত এই ৯ ঘণ্টায় প্রতি
কসাই টিম গরু প্রসেস করতে পারবে সর্বোচ্চ ৩টি। তাহলে ১ লক্ষ কসাই টিম ঈদের দিন প্রসেসিং
করতে পারবে সর্বোচ্চ ৩ লক্ষ গরু। এবং ঈদের তিন দিনে করতে পারবে ৯ লক্ষ গরু। অথচ ঢাকায়
কুরবানী হয় প্রায় ৩০ লক্ষ গরু। তার মানে এক-তৃতীয়াংশ গরুও জবাই করা সম্ভব হবে না। এরপর
ছাগল ও ভেড়া তো রয়েছেইে।
ঘ) গোশত প্রসেসিংয়ের পর সেই গোশত বাসায় নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা কি হবে সেটাও নির্ধারণ
করতে হবে। রেডি রাখতে হবে কয়েক লক্ষ ভ্যান গাড়ি। এছাড়া স্পটগুলোকে কাজ করার জন্য লক্ষ
লক্ষ সেচ্ছাসেবী দরকার পড়বে, যার ব্যবস্থা আগেই রাখতে হবে তাদের। কিন্তু সরকার সে ধরনের কোনো ব্যবস্থাই নেয়নি।
জনগণের এত ধৈর্য আছে কি? তারা কতটুকু সহনশীল থাকবে?
এত লোক এক সাথে কুরবানী করতে গেলে প্রত্যেক স্পটে বিরাট ভীড় সৃষ্টি হবে। ঘণ্টার
পর ঘণ্টা সিরিয়াল ধরে গরু জবাই করার ধৈর্য ও মন-মানসিকতা জনগণের থাকতে হবে। কিন্তু
সেটা জনগণের আছে কি?
কারণ অনেক ক্ষেত্রে দেখা যাবে সকাল বেলা কসাইয়ের সিরিয়াল পাওয়া যাচ্ছে না,
সুযোগ পাওয়া গেছে সন্ধ্যায়।
কিংবা সিরিয়াল আসতে আসতে ঈদের তৃতীয় দিন এসেছে।
এত লোকের কুরবানী এক সাথে হলে অনেকের সাথে অনেকের গরু ও গরুর গোশতের মধ্যে অদল-বদল
হয়ে যাওয়াও স্বাভাবিক। সেটা কি জনগণ সহনশীলতার সাথে মেনে নিবে? কিংবা সরকার কর্তৃক নির্ধারিত
কসাই কি জনগণের ইচ্ছা পূরণ করে গোশত কাটতে পারবে?
আইন-শৃঙ্খলা কতটুকু নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে সরকার?
১) সরকার কর্তৃক নির্ধারিত স্থানে এলাকার গুন্ডা ও মাস্তানদের দৌরাত্ম্য থাকবে একশ’
ভাগ। জনগণ ওই সব স্থান
থেকে গোশত ও চামড়া নিয়ে কি বাড়িতে নিরাপদে ফিরতে পারবে? নাকি গুন্ডা-মাস্তানরা তাদের গোশত
ছিনিয়ে নিয়ে যাবে?
২) এতগুলো স্পটে এক সাথে এতগুলো কুরবানী হবে। সেই সময় যেকোনো ধরনের বিশৃঙ্খলতা
ও মারামারি হওয়া স্বাভাবিক। তাই প্রতি স্পটে অনেক পুলিশ নিয়োজিত রাখতে হবে। প্রতি স্পটে
যদি ২০০ করে পুলিশ তাকে তবে ৫০০ স্পটে থাকবে ১ লক্ষ পুলিশ সদস্য নিয়োজিত রাখতে হবে।
এ সিস্টেমে স্পটগুলোতে কুরবানীদাতা, এলাকার মাস্তান ও গোশত সংগ্রহকারী টোকাইদের মধ্যে গোশত-চামড়া
নিয়ে ত্রিমুখী সংর্ঘষ বাঁধতে পারে। এতে দাঙ্গা ও পদপিষ্ট হয়ে হাজার হাজার মানুষের প্রাণহানী
ঘটতে পারে। সরকার যদি প্রচুর সংখ্যক আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী দিয়ে বিষয়টি নিয়ন্ত্রণ না করতে
পারে, তবে বড় ধরনের দাঙ্গা
সৃষ্টি হতে পারে; যার মাধ্যমে হাজার হাজার লোকের প্রাণহানী ঘটা স্বাভাবিক।
এ ধরনের সিস্টেম তৈরি করতে বড় বাজেট, জনবল, ব্যাপক প্রশিক্ষণ ও সময়ের প্রয়োজন:
সরকার কুরবানী নিয়ে যে সিস্টেম তৈরি করতে চাচ্ছে সেটা করতে অনেক বড় বাজেটের দরকার।
পুরো সিস্টেম তৈরি করতে লক্ষ লক্ষ জনবল ও তাদের প্র্রশিক্ষণের প্রয়োজন আছে। কিছুদিন
আগে আমরা দেখেছি, কথিত ‘লাখো কণ্ঠে সোনার বাংলা’ নামক অনুষ্ঠানে একটি মাঠে এক লক্ষ লোককে জড়ো করতে সরকারের লেজে গোবরে অবস্থা হয়েছে।
অনেক প্রশিক্ষণ দিয়ে, আর্মি-পুলিশ দিয়েও বিশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হয়নি। বলাবাহুল্য, মাত্র পাঁচ মিনিট সময়ের একটি
বিষয় যদি সরকার নিয়ন্ত্রণ করতে না পারে, তবে কুরবানীর পশু জবাই ও প্রসেসিংয়ের মতো একটি জটিল ও সময় সাপেক্ষ
প্রক্রিয়া সরকার কোন্ বুদ্ধিতে কাঁধে নিচ্ছে সেটা বোধগম্য নয়।
উপরের আলোচনা দ্বারা এটা স্পষ্ট- ‘সরকার কর্তৃক নির্ধারিত স্থানে কুরবানী উনার পশু জবাই’
নামক সিস্টেমে একদিকে
যেমন মুসলমানদের ধর্মীয় অধিকার সংরক্ষিত হয় না, অন্যদিকে এ ধরনের একটি বিরাট
দায়িত্ব পালন সরকারের পক্ষে কখনোই সম্ভব নয়; বরং আকাশ কুসুম কল্পনাও বটে।
দেখা যাবে, সরকার বিষয়টি নিয়ন্ত্রণ করতে না পারায় দেশে গৃহযুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে, তখন কি হবে?
সরকারে মনে রাখা উচিত ছিলো, সে জনগণের সেবা করতে এসেছে, দেশ পরিচালনা করতে এসেছে, কিন্তু ধর্মীয় বিষয় তাজদীদ করতে আসেনি, মানুষের ধর্মীয় ইস্যু নিয়ে ছিনিমিনি
খেলতেও আসেনি। তার উচিত ছিলো- কুরবানীর মতো একটি ধর্মীয় ইস্যুতে সিদ্ধান্ত নেয়ার আগে
হক্কানী-রব্বানী আলিম সমাজের সাথে মিটিং করা, তাদের অভিমত নেয়া। কিন্তু হক্কানী-রব্বানী
আলিম সমাজের অভিমত না নিয়েই সরকার দেশের জনগণের ধর্মীয় ইস্যুতে হটকারী সিদ্ধান্ত নিয়েছে,
যা সত্যিই ন্যক্কারজনক।
তাই সরকারেরই উচিত- এ ধরনের উদ্ভট চিন্তা থেকে সরে আসা, নয়তো উদ্ভুত বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি সরকারের জন্য সুখকর হবে না বলে
পর্যবেক্ষক মহল মনে করেন।
No comments:
Post a Comment