Monday, March 31, 2014

রোহিঙ্গা মুসলমানদেরকে ‘বাঙালি’ হিসেবে নিবন্ধিত করছে যালিম বার্মিজ বৌদ্ধরা

মুছে ফেলছে জাতিগত তথা নৃ-তাত্ত্বিক পরিচয়। রোহিঙ্গা মুসলমানদেরকে ‘রেহিঙ্গা’ জাতি হিসেবে নয়; বরং অভিবাসী ‘বাঙালি’ হিসেবে নিবন্ধিত করছে যালিম বার্মিজ বৌদ্ধরা। মূলত, ১৯৮৩ সালে প্রথমবারের মতো আদমশুমারি অনুষ্ঠিত হওয়ার পর থেকেই মিয়ানমারে জাতিগত সংঘাত দানা বাঁধতে শুরু করে। গত ২৯ মার্চ (২০১৪ ঈসায়ী) শনিবার মিয়ানমার সরকারের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, রোববার (৩০ মার্চ -২০১৪) থেকে শুরু হওয়া আদমশুমারিতে দেশটির মুসলমান সম্প্রদায়ভুক্ত নাগরিকরা ‘রোহিঙ্গা’ হিসেবে নিবন্ধিত হতে পারবেন না। তবে ‘বাঙালি’ হিসেবে তারা নিবন্ধিত হতে পারবেন। এর মাধ্যমে গত তিন দশক ধরে চলা এই জাতিগত সংঘাতকে এবার সরকার প্রকাশ্যে উসকে দিলো।

মিয়ানমার সরকারের এই ঘোষণার পেছনের খোঁড়া যুক্তিটি হলো: এই আদমশুমারির মাধ্যমে মিয়ানমারের রোহিঙ্গা সম্প্রদায়ের জনগণকে সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃতি দিতে পারে- এই আশঙ্কায় দেশটির পশ্চিমাঞ্চলে বসবাসরত বৌদ্ধদের আদমশুমারি বর্জনের ঘোষণা দেয়া ও এর ফলে দেশটিতে উদ্ভূত অস্থির পরিস্থিতি।
ইয়াঙ্গুনে সরকারের এক মুখপাত্র ইয়ে হুত সাংবাদিকদের বলেছে, “যদি কোনো ব্যক্তি বা পরিবার নিজেদের ‘রোহিঙ্গা’ পরিচয়ে নিবন্ধিত করতে চাইলেও তা পারবেন না।”
সে জানায়, সরকার ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ, যারা ‘রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী’র অধিকাংশ ব্যক্তিকে মিয়ানমারের প্রতিবেশী দেশ বাংলাদেশ থেকে আগত অবৈধ অভিবাসী হিসেবে মনে করে, তারা ‘রোহিঙ্গা’র পরিবর্তে এদের ‘বাঙালি’ হিসেবে অভিহিত করবে। বার্তা সংস্থা এএফপি এ তথ্য জানিয়েছে।
মিয়ানমারে নিযুক্ত বাংলাদেশী রাষ্ট্রদূত অনুপ কুমার চাকমা জানায়, মিয়ানমারের নাগরিকত্ব আইন, ১৯৮২ প্রায় ১৩৫টি ভিন্ন জাতিকে স্বীকৃতি দিয়েছিল এবং এই জাতিগুলোর মধ্যে রোহিঙ্গারা ছিল না। দেশটির রাখাইন (আরাকান) রাজ্যে চলমান জাতিগত সমস্যার সমাধানের জন্য চলতি আদমশুমারিটিকে একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হিসেবে নেয়া যেতে পারে বলে দাবি করেছে সে।
১৯৮৩ সালের পর মিয়ানমার সরকার এই প্রথম কোনো আদমশুমারি অনুষ্ঠিত করছে। জাতিসংঘের ইউএনএফপিএ এবং অন্যান্য বিদেশী সংস্থার সহযোগিতায় কর্মসূচিটি অনুষ্ঠিত হচ্ছে।
এএফপি জানিয়েছে, আদমশুমারিকে কেন্দ্র করে রাখাইন (আরাকান) রাজ্যের পরিস্থিতি উত্তপ্ত হতে শুরু করেছে এবং চলতি সপ্তাহেই এই অস্থিরতার ধারাবাহিকতায় হিংস্রতাবাদী উগ্র বৌদ্ধরা রাখাইনে অবস্থিত বিদেশী সংস্থাগুলোর কার্যালয়ে হামলাও করেছে। এই ঘটনার পর সংশ্লিষ্ট বিদেশী কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা রাখাইন (আরাকান) ত্যাগ করেছে।
রাখাইনের (আরাকান) রাজধানী সিত্তেতে (আকিয়াব) একদল বিক্ষুব্ধ হিংস্রতাবাদী উগ্র বৌদ্ধকে সতর্ক করার উদ্দেশ্যে পুলিশ ফাঁকা গুলি ছুড়লে তাতে ১১ বছরের একটি মেয়ে নিহত হয়।
অঞ্চলটিতে কর্মরত মানবাধিকার কর্মীদের উপর ক্ষুব্ধ বৌদ্ধ সন্ত্রাসবাদীরা তাদের বিরুদ্ধে স্থানীয় মুসলমানদের পক্ষপাতিত্বের অভিযোগে চাপ প্রয়োগ করে যাচ্ছে।
জাতিসংঘ অঞ্চলটি থেকে প্রায় ৫০ জন আন্তর্জাতিক পর্যায়ের এবং তাদের হয়ে কাজ করা কয়েকজন মিয়ানমারের নাগরিককে সরিয়ে নিচ্ছে। এছাড়া আরো কিছু বড় মানবাধিকার সংস্থাও অঞ্চলটি থেকে সাময়িকভাবে তাদের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সরিয়ে নিচ্ছে।
দেশটিতে সাবেক জান্তা সরকারের শাসনামলে যে তথ্য ঘাটতি সৃষ্টি হয়েছে তা থেকে বের হওয়ার লক্ষ্যেই এই আদমশুমারির সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার।
ভিন্ন জাতিগত ও ধর্মীয় সম্প্রদায়ের জনগণকে আদমশুমারির আওতাভুক্ত করা হবে কিনা তা নিয়ে প্রশ্ন উঠায় জনসংখ্যা গণনার এই প্রকল্প নিয়ে দেশটিতে ব্যাপক উত্তেজনা সৃষ্টি হয়েছে। সমালোচকরা বলছে, এই উত্তেজনা আরো বাড়বে এবং দেশটির সংখ্যালঘু ও বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোর সঙ্গে শান্তি আলোচনার বিষয়টি হুমকির মুখে পড়ে আরো পিছিয়ে যাবে।
এই আদমশুমারির বিষয়ে অত্যন্ত ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে দেশটির বৌদ্ধ সন্ত্রাসবাদী জনগোষ্ঠী। আদমশুমারির জন্য প্রণীত প্রশ্নমালাকে কেন্দ্র করে এই ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে। তাদের অভিযোগ, প্রণীত প্রশ্নমালা থেকে বোঝা যাচ্ছে যে এই আদমশুমারির মাধ্যমে এমন জনগোষ্ঠীগুলোকেও নিবন্ধিত করা হচ্ছে যারা নিজেরাই নিজেদের সম্প্রদায়ের পরিচয় সৃষ্টি করছে, অর্থাৎ বিশেষ করে রোহিঙ্গা মুসলমানদেরকেই এই আদমশুমারির মাধ্যমে স্বীকৃতি দেয়া হচ্ছে। আদমশুমারির বিরোধী এই পক্ষের আশঙ্কা, এর মাধ্যমে রোহিঙ্গা সম্প্রদায়ের মানুষের রাজনৈতিক অধিকারও নিশ্চিত হবে।
তবে স্থানীয় সংসদ সদস্য অং মিয়া ক্যাও’র ভাষ্য অনুযায়ী- রাজ্য সরকারের কর্মকর্তারা নিশ্চিত করছে যে রোহিঙ্গা কথাটিকে গোনায় ধরা হবে না। এএফপিকে সে বলেছে, “তাদেরকে শুধুই ‘বাঙালি’ হিসেবে চিহ্নিত করা হচ্ছে, কারণ রোহিঙ্গা বলে কোনো কিছুর অস্তিত্বই নেই।”
রাখাইনের (আরাকানের) হিং¯্রতাবাদী বৌদ্ধরা মুসলমান জনগণকে দীর্ঘদিন ধরেই বৈরী মনোভাব নিয়ে দেখে আসছে; যার ধারাবাহিকতায় ২০১২ সালে দুই সম্প্রদায়ের মানুষের মধ্যে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের সৃষ্টি হয়েছিল। সংঘর্ষে শত শত নিহত এবং প্রায় এক লাখ ৪০ হাজার রোহিঙ্গা মুসলমান উদ্বাস্তু হন।
রাখাইনের (আরাকানের) প্রত্যন্ত অঞ্চলের স্থানীয় মুসলমানদের অভিযোগ- নিজেদের রোহিঙ্গা বলে পরিচয় দিলে কঠোর পরিণতি দেখতে হবে বলে তাদেরকে হুমকে দিয়েছে প্রশাসন।
রোহিঙ্গাদের ভ্রমণ, পেশা এবং এমনকি বিবাহজীবনের উপরেও কঠোর নিষেধাজ্ঞা রয়েছে মিয়ানমারে। ৭০-এর দশকের পর থেকে মিয়ানমারের সাবেক জান্তা সরকার রোহিঙ্গাদের বিষয়ে কঠোর নীতি অবলম্বন করতে শুরু করলে প্রাণ বাঁচানোর জন্য সীমান্ত দিয়ে নিজ দেশ থেকে প্রতিবেশী দেশ বাংলাদেশে রোহিঙ্গা সম্প্রদায়ের জনগোষ্ঠীর অসংখ্য মানুষ অনুপ্রবেশ করতে শুরু করেন।
মিয়ানমারের সীমান্তবর্তী চট্টগ্রামের টেকনাফ ও উখিয়ার দুটি শিবিরে বর্তমানে ৩০ হাজার রোহিঙ্গা শরণার্থী বসবাস করছেন। তবে ধারণা করা হয়, প্রকৃতপক্ষে অন্তত পাঁচ লাখ রোহিঙ্গা শরণার্থী নথিভুক্ত না হয়েই বাংলাদেশে বসবাস করছেন।


No comments:

Post a Comment